মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৯৭
কৃষ্ণ ও কুন্তীর সাক্ষাৎকার এবং কুন্তী বর্ণিত বিদুলার কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
কৃষ্ণ ও কুন্তীর সাক্ষাৎকার এবং কুন্তী বর্ণিত বিদুলার কাহিনি
কৌরবসভা থেকে বেরিয়ে কৃষ্ণ কুন্তীর সঙ্গে দেখা কোরে প্রণাম করার পর তাকে কৌরবসভার সমস্ত ঘটনার কথা জানালেন। কুন্তী কৃষ্ণকে বললেন, তুমি যুধিষ্ঠিরকে আমার এই কথা বলো -পুত্র, তুমি মন্দমতি, ব্রাহ্মণের ন্যায় কেবল শাস্ত্র আলোচনা করে তোমার বুদ্ধি বিকৃত হয়েছে, তুমি কেবল ধর্মেরই চিন্তা করছো। ক্ষত্রিয়ের যে ধর্ম ব্রহ্মা নির্দিষ্ট করেছেন, তুমি তার দিকে মন দাও। তিনি তাঁর বাহু থেকে ক্ষত্রিয় সৃষ্টি করেছেন সেজন্য বাহুবলই ক্ষত্রিয়গণের উপজীব্য, প্রয়োজনে নির্দয় কর্মে নিযুক্ত থেকে তাদের প্রজাপালন করতে হয়। রাজা যদি উপযুক্ত রূপে দণ্ডনীতি প্রয়োগ করেন তবেই চার বর্ণের লোক স্বধর্ম পালন করেন। এমন মনে করো না যে কালের প্রভাবেই রাজার দোষগুণ হয়, রাজার কর্ম অনুসারেই সত্য ত্রেতা দ্বাপর বা কলি যুগ উৎপন্ন হয়। তুমি পিতৃ-পিতামহের আচরিত রাজধর্ম পালন করো, তুমি যে ধর্ম আশ্রয় করতে চাও তা রাজার ধর্ম নয়। দুর্বল বা অহিংসাপরায়ণ রাজা প্রজাপালন করতে পারেন না। আমি সর্বদা এই আশীর্বাদ করছি যে তুমি যজ্ঞ, দান ও তপস্যা করো, শৌর্য বল ও তেজ লাভ করো। মহাবাহু, সাম দান ভেদ বা দণ্ডনীতির দ্বারা তোমার পৈতৃক রাজ্য উদ্ধার করো। তোমার মা হয়েও আমাকে পরের দেওয়া অন্নের প্রত্যাশায় থাকতে হয়, এর চেয়ে দুঃখ আর কি আছে? কৃষ্ণ, আমি বিদুলা ও তাঁর পুত্রের কথা বলছি, তুমি যুধিষ্ঠিরকে শুনিও -
বিদুলা নামে এক যশস্বিনী তেজস্বিনী ক্ষত্রিয়নারী ছিলেন। তাঁর পুত্র সঞ্জয় সিন্ধুরাজ কর্তৃক পরাজিত হয়ে দুঃখিতমনে শুয়ে আছেন দেখে বিদুলা বললেন, তুমি আমার পুত্র নও, তুমি কোথা থেকে এসেছ? তুমি ক্রোধহীন ক্লীবতুল্য, তুমি যাবজ্জীবন নিরাশ হয়ে থাকতে চাও। নিজেকে অবজ্ঞা কোরো না, অল্পে তুষ্ট হয়ো না, নির্ভীক ও উৎসাহী হও। ক্লীবের মতো তোমার সকল কীর্তি নষ্ট হয়েছে, তোমার রাজ্য পরে দখল করেছে, তবে বেঁচে আছ কেন? লোকে যার মহৎ চরিত্রের আলোচনা করে না সে পুরুষ নয়, স্ত্রীও নয়, সে কেবল মানুষের সংখ্যা বাড়ায়। যার দান তপস্যা শৌর্য বিদ্যা বা অর্থের খ্যাতি নেই সে তার মাতার কুপুত্র। পুত্র, নিভে যাওয়া আগুনের মতো কেবল ধূমায়িত হয়ো না, আবার জ্বলে ওঠো, শত্রুকে আক্রমণ করো।
বিদুলার পুত্র সঞ্জয় বললেন, আমি যদি যুদ্ধে মরি তবে সমস্ত পৃথিবী পেয়েও আপনার কি লাভ হবে? বিদুলা বললেন, যিনি নিজের বাহুবল আশ্রয় করে জীবনধারণ করেন তিনিই কীর্তি ও পরলোকে সদ্গতি লাভ করেন। সিন্ধুরাজের প্রজারা সন্তুষ্ট নয়, কিন্তু তারা মুর্খ ও দুর্বল, তাই রাজার থেকে বিপদের আশঙ্কায় নিশ্চেষ্ট হয়ে আছে। তুমি যদি নিজের পৌরুষ দেখাও তবে অন্য রাজারা সিন্ধুরাজের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন। তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তুমি পর্বতের দুর্গে থেকে সুযোগের প্রতীক্ষা করো, সিন্ধুরাজ অজর অমর নন। যুদ্ধের ফলে তোমার সমৃদ্ধিলাভ হবে কিংবা ক্ষতি হবে তার বিচার না করেই যুদ্ধ করো। আমি মহান কুলে জন্মগ্রহণ করে তোমাদের মহান কুলে এসেছি, আমি রাজ্যের অধিশ্বরী মঙ্গলময়ী ও পতির আদরিণী ছিলাম। সঞ্জয়, আমাকে আর তোমার পত্নীকে যদি দীনদশাগ্রস্ত দেখ তবে তোমার জীবনে প্রয়োজন কি? শত্রুদের বশে আনতে পারলে ক্ষত্রিয় যে সুখ লাভ করেন সে সুখ ইন্দ্রের ভবনেও নেই। যুদ্ধে প্রাণবিসর্জন অথবা শত্রুর বিনাশ -এ ছাড়া ক্ষত্রিয়ের শান্তিলাভ হোতে পারে না।
সঞ্জয় বললেন, আপনি আমার প্রতি নিষ্ঠুর, আপনার হৃদয় লোহা নির্মিত। আমার ধন নেই, সহায়ও নেই, কি করে জয়লাভ করবো? এই দারুণ অবস্থা জেনেই আমার রাজ্যোদ্ধারের ইচ্ছা লুপ্ত হয়েছে। আপনি পরিণতবুদ্ধি, যদি কোনও উপায় জানেন তো বলুন, আমি সর্বতোভাবে আপনার আদেশ পালন করবো।
বিদুলা বললেন, তুমি পূর্বে যে বীরত্ব দেখিয়েছ তা আবার দেখাও, তা হলেই রাজ্য উদ্ধার করতে পারবে। যারা সিন্ধুরাজের উপর ক্রুদ্ধ, যাদের তিনি শক্তিহীন ও অপমানিত করেছেন, যারা তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায়, তাদের সঙ্গে তুমি মিত্রতা কর। তুমি জান না, আমাদের রাজকোষে বহু ধন আছে। তোমার অনেক শুভানুধ্যায়ীও আছেন যাঁরা দুঃখ সইতে পারেন এবং যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যান না।
বিদুলার কথায় সঞ্জয়ের মোহ দূর হোলো। তিনি মায়ের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে মায়ের উপদেশে যুদ্ধের উদ্যোগ করলেন এবং জয়ী হলেন। কোনও রাজা শত্রুর আক্রমণে পরাজিত হোলে তাকে তার মন্ত্রী এই ধরণের উৎসাহজনক কাহিনি শোনাবেন।
কুন্তীকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করে কৃষ্ণ ভীষ্মাদির নিকট বিদায় নিলেন, তার পর কর্ণকে নিজের রথে তুলে নিয়ে সাত্যকির সঙ্গে যাত্রা করলেন।
______________
(ক্রমশ)