Story of Mahabharat - Part 107 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 107

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 107

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১০৭

বেদব্যাস ও ধৃতরাষ্ট্রের কথোপকথন এবং সঞ্জয় কর্তৃক জীব ও ভূমির বিষয়ে বর্ণনা

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

 

বেদব্যাস ও ধৃতরাষ্ট্রের কথোপকথন এবং সঞ্জয় কর্তৃক জীব ও ভূমির বিষয়ে বর্ণনা

কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে আসন্ন যুদ্ধের জন্য ধৃতরাষ্ট্র শোকার্ত হয়ে নির্জন স্থানে বসে পুত্রদের দুর্নীতির বিষয় ভাবছিলেন এমন সময় ত্রিকালজ্ঞ বেদব্যাস তার কাছে এসে বললেন, তোমার পুত্রদের এবং অন্য রাজাদের মৃত্যুকাল আসন্ন হয়েছে, তারা যুদ্ধে পরস্পরকে বিনষ্ট করবেন। কালের প্রভাবেই এমন হবে এই জেনে তুমি শোক দূর করো। পুত্র, যদি তুমি যুদ্ধ দেখতে চাও তবে আমি তোমাকে দিব্যদৃষ্টি দেবো।

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ব্রহ্মর্ষিশ্রেষ্ঠ, জ্ঞাতিবধ দেখতে আমার রুচি নেই, কিন্তু আপনার আশীর্বাদে এই যুদ্ধের সম্পূর্ণ বিবরণ শুনতে চাই। ব্যাস বললেন, সঞ্জয় আমার বরে দিব্যচক্ষু লাভ করবে, যুদ্ধের সমস্ত ঘটনা দেখেতে পাবে এবং তোমাকে যুদ্ধের বিবরণ বলবে। সঞ্জয় কোনো অস্ত্রে আহত হবে না, শ্রমে ক্লান্ত হবে না, জীবিত থেকে এই যুদ্ধ থেকে নিষ্কৃতি পাবে। আমিও কুরুপাণ্ডবের কীর্তিকথা প্রচার করবো। তুমি শোক করো না, সমস্তই দৈবের বশে ঘটবে, যেখানে ধর্ম সেখানেই জয় হবে। এই যুদ্ধে অসংখ্য লোকক্ষয় হবে, আমি সেই ভয়ংকর ঘটনা দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি। রাত্রে বিড়াল ও শূকর যুদ্ধ করে, তাদের ভয়ংকর গর্জন অন্তরীক্ষে শোনা যায়। দেবপ্রতিমা কাঁপতে থাকে, হাসতে থাকে, রক্ত বমন করে, ঘামে ভিজে যায় এবং ভূপতিত হয়। যিনি ত্রিলোকে সাধ্বী বলে খ্যাত সেই অরুন্ধতী বশিষ্ঠের দিকে পিঠ ফিরিয়েছেন। কোনও কোনও নারী চার পাঁচটি করে কন্যা প্রসব করছে, সেই কন্যারা ভূমিষ্ঠ হয়েই নাচছে গাইছে আর হাসছে। বৃক্ষ ও আশ্রম পড়ে যাচ্ছে, আহুতির পর যজ্ঞাগ্নি থেকে দুর্গন্ধময় নীল লাল ও হলুদ বর্ণের শিখা বায়ুমণ্ডলে উঠছে। স্পর্শ গন্ধ ও স্বাদ বদলে যাচ্ছে। পাখিরা কর্কশ রব করে পতাকায় বসে রাজাদের ক্ষয় সূচনা করছে। ধৃতরাষ্ট্র, তোমার আত্মীয় ও শুভানুধ্যায়ীদেরকে ধর্মসংগত পথ দেখাও। তুমি এই যুদ্ধ নিবারণে সমর্থ। জ্ঞাতিবধ অতি হীন কার্য এবং আমার অপ্রিয়, তুমি তা হতে দিও না। যাতে তুমি পাপগ্রস্ত হবে তেমন রাজ্যে তোমার কি প্রয়োজন? পাণ্ডবরা তাদের রাজ্য লাভ করুক, কৌরবরা শান্ত হোক।

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, পিতা, মানুষ স্বার্থের জন্য মোহগ্রস্ত হয়, আমিও মানুষ মাত্র। আমার অধর্মে মতি নেই, কিন্তু পুত্রগণ আমার বশে নেই। আপনি আমার উপর প্রসন্ন হন। ব্যাস বললেন, সাম ও দান নীতিতে যে জয়লাভ হয় তাই শ্রেষ্ঠ, ভেদের দ্বারা যা হয় তা মধ্যম এবং যুদ্ধ দ্বারা যা হয় তা অধম। প্রচুর সেনা থাকলেই জয়লাভ হয় না, জয় অনিশ্চিত এবং দৈবের বশেই ঘটে। যাঁরা এক সময় বিজয়ী হন তারাই আবার পরে পরাজিত হন।

ব্যাসদেব চলে গেলে ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে বললেন, রাজারা ভূমি অধিকারের জন্যই যুদ্ধ করেন, অতএব ভূমির বহু গুণ আছে। আমি তা শুনতে চাই।

সঞ্জয় বললেন, মহারাজ, আমার যা জানা আছে তা বলছি। জগতে দুই প্রকার জীব আছে, জঙ্গম ও স্থাবর। জঙ্গম জীব ত্রিবিধ – অণ্ডজ, স্বেদজ ও জরায়ুজ, এদের মধ্যে জরায়ুজই শ্রেষ্ঠ, আবার জরায়ুজের মধ্যে মানুষ ও পশু শ্রেষ্ঠ। সিংহ , বাঘ, শুয়োর, মহিষ, হাতি, ভল্লুক ও বানর — এই সাত প্রকার বন্য জরাযুজ। গরু, ছাগল, ভেড়া, মানুষ, ঘোড়া ও গাধা — এই সপ্ত প্রকার লোকালয় জরায়ুজ। লোকালয়ের জীবদের মধ্যে মানুষ এবং বন্য জীবদের মধ্যে সিংহ শ্রেষ্ঠ। সমস্ত জীবই পরস্পরের উপর নির্ভর করে। উদ্ভিজ্জ সকল স্থাবর, তাদের পঞ্চ জাতি – বৃক্ষ, গুল্ম, লতা, বল্লী ও তৃণ। চোদ্দ জঙ্গম জীব, পঞ্চ স্থাবর জীব এবং পঞ্চ মহাভূত — এই চব্বিশ জীব ও ভূত গায়ত্রীর তুল্য। যিনি এই গায়ত্রী যথার্থরূপে জানেন তিনি বিনষ্ট হন না। সমস্তই ভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে ভূমিতেই বিনাশ পায়, ভূমিই সর্ব জীবের পরম আশ্রয়। যার ভূমি আছে সে স্থাবর ও জঙ্গমের অধিকারী, এই কারণেই রাজারা ভূমির লোভে পরস্পরকে হত্যা করেন।

তার পর সঞ্জয় ভূমি, জল, বায়ু, অগ্নি ও আকাশ এই পঞ্চ মহাভূত এবং তাদের গুণাবলী বর্ণনা কোরে সুদর্শন দ্বীপ বা জম্বু দ্বীপের কথা বললেন। জম্বু দ্বীপে ছয় বর্ষপর্বত আছে, যথা — হিমালয়, হেমকূট, নিষধ, নীল, শ্বেত ও শৃঙ্গবান। এই সকল বর্ষপর্বত পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত এবং উভয় প্রান্তে সমুদ্রে আছে। এই পর্বতগুলির মধ্যে বহু হাজার যোজন বিস্তৃত বিভিন্ন জনপদ আছে, তাদের নাম বর্ষ। হিমালয়ের দক্ষিণে ভারতবর্ষ, উত্তরে কিম্পুরুষগণের বাসভূমি হৈমবতবর্ষ। হেমকূটের উত্তরে হরিবর্য। নিষধ পর্বতের উত্তরে এবং নীল পর্বতের দক্ষিণে মাল্যবান পর্বত। মাল্যবানের পর গন্ধমাদন এবং এই দুই পর্বতের মধ্যে স্বর্ণময় মেরু পর্বত। মেরু পর্বতের চার পাশে চার মহাদেশ আছে – ভদ্রাশ্ব, কেতুমাল, জম্বুদ্বীপ ও উত্তরকুরু। নীল পর্বতের উত্তরে শ্বেতবর্ষ, তার পর হৈরণ্যকবর্ষ এবং তার পর ঐরাবতবর্ষ। দক্ষিণে ভারতবর্ষ এবং উত্তরে ঐরাবতবর্য - এই দুইয়ের মধ্যে ইলাবৃত সমেত পাঁচটি বর্ষ।

অন্যান্য বর্ষের বর্ণনা করে সঞ্জয় বললেন, মহারাজ, ভারতবর্ষে সাতটি কুল-পর্বত আছে, যথা-মহেন্দ্ৰ, মলয়, সহ্য, শুক্তিমান, ঋক্ষবান, বিন্ধ্য ও পারিপাত্র। গঙ্গা, সিন্ধু, সরস্বতী, গোদাবরী, নর্মদা, শতদ্রু, বিপাশা, চন্দ্রভাগা, ইরাবতী, বিতস্তা, যমুনা প্রভৃতি অনেক নদী আছে, এই সকল নদী মাতৃতুল্য ও মহাফলপ্রদ। ভারতে বহু দেশ আছে, যথা – কুরুপাঞ্চাল, শাল্ব, শূরসেন, মৎস্য, চেদি, দশার্ণ, পাঞ্চাল, কোশল, মদ্ৰ, কলিঙ্গ, কাশী, বিদেহ, কাশ্মীর, সিন্ধু, সৌবীর, গান্ধার প্রভৃতি, দক্ষিণে দ্রাবিড়, কেরল, কর্ণাটক প্রভৃতি এবং উত্তরে যবন, চীন, কম্বোজ, হূণ, পারসীক প্রভৃতি ম্লেচ্ছ জাতির দেশসমূহ। কুকুর যেমন মাংসখণ্ড নিয়ে কাড়াকাড়ি করে, রাজারাও তেমনি পরস্পরের ভূমি দখল করেন, কিন্তু এ পর্যন্ত কারও কামনার তৃপ্তি হয়নি।

তার পর সঞ্জয় চতুর্যুগ, শাক, কুশ, শাল্মলি ও ক্রৌঞ্চ দ্বীপের বৃত্তান্ত এবং রাহু ও চন্দ্ৰসূর্যের পরিমাণ বর্ণনা কোরে বললেন, মহারাজ, আমরা যেখানে আছি এই দেশই ভারতবর্ষ, এখান থেকেই সর্বপ্রকার পুণ্যকর্ম প্রবর্তিত হয়েছে।

______________

(ক্রমশ)