মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১০৮
কৌরব ও পাণ্ডবদের সৈন্যসজ্জার কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
কৌরব ও পাণ্ডবদের সৈন্যসজ্জার কাহিনি
বেদব্যাস ও ধৃতরাষ্ট্রের মধ্যে কথোপকথনের পরদিন সূর্যোদয় হলে কৌরব ও পাণ্ডব সৈন্যগণ সজ্জিত হয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হোলো। বিশাল কৌরববাহিনীর সামনে ভীষ্ম সাদা উষ্ণীষ ও বর্ম পরিধান কোরে সাদা রং-এর ঘোড়া চালিত রজতময় রথে উঠলেন। পিতামহ ভীষ্ম এবং দ্রোণাচার্য প্রতিদিন সকালে উঠে বলতেন — পাণ্ডুপুত্রদের জয় হোক, কিন্তু তারা ধৃতরাষ্টের আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন এই কারণেই কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করতে এলেন।
কৌরবপক্ষীয় রাজাদের ডেকে ভীষ্ম বললেন, ক্ষত্রিয়গণ, যুদ্ধে মৃত্যুবরণ কোরে স্বর্গযাত্রার জন্য এই দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে, এই পথে তোমরা ইন্দ্রলোকে ও ব্রহ্মলোকে যেতে পারবে। রোগভোগ কোরে মরা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে অধর্মকর, অস্ত্রের আঘাতে যে ক্ষত্রিয় মরেন তিনি স্বর্গলাভ করেন। এই কথা শুনে রাজারা নিজেদের সৈন্যসহ যুদ্ধযাত্রা করলেন। কর্ণ ও তার বন্ধুদের ভীষ্ম মানা করলেন। অশ্বত্থামা, ভূরিশ্রবা, দ্রোণাচার্য, দুর্যোধন, শল্য, কৃপাচার্য, জয়দ্রথ, ভগদত্ত প্রভৃতি সসৈন্যে যুদ্ধের জন্য এগিয়ে গেলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন ও বাহ্লীকরাজ যে ভাবে সৈন্য সাজালেন তার মাঝখানে গজারোহী সৈন্য, সামনে রাজাগণ এবং পাশে অশ্বারোহী সৈন্য সাজানো হোলো।
কৌরবদের সৈন্য সজ্জিত হয়েছে দেখে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, বৃহস্পতির উপদেশ এই যে সৈন্য যদি অল্প হয় তবে একত্রিত কোরে যুদ্ধ করবে, যদি বহু হয় তবে ইচ্ছানুসারে বিভিন্ন ভাবে সজ্জিত করবে। বহু সৈন্যের সঙ্গে যদি অল্প সৈন্যের যুদ্ধ করতে হয়, তবে সৈন্যদের সূচীমুখ ব্যূহ রচনা করবে। অর্জুন, আমাদের সৈন্য বিপক্ষের তুলনায় অল্প, তুমি বৃহস্পতির বচন অনুসারে ব্যূহ রচনা করো। অর্জুন বললেন, মহারাজ, বজ্ৰপাণি ইন্দ্র সৈন্যদের সজ্জিত করার জন্য যে ব্যূহের বিধান দিয়েছেন সেই ‘অচল’ ও ‘বত্র’ নামক ব্যূহ আমি রচনা করছি।
কৌরবসেনা এগিয়ে আসছে দেখে পাণ্ডববাহিনী ক্ষণকাল নিশ্চল থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগল। গদা হাতে নিয়ে ভীম সেই বাহিনীর সামনে রইলেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন, নকুল, সহদেব এবং ভাই ও পুত্রের সঙ্গে বিরাট রাজা ভীমের পিছন দিকে রক্ষা করতে লাগলেন। অভিমন্যু, দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র ও শিখণ্ডী সঙ্গে সঙ্গে গেলেন। সাত্যকি অর্জুনের পিছন দিকে রক্ষক হয়ে চললেন। চলন্ত পর্বতের ন্যায় বৃহৎ হাতির দলসহ রাজা যুধিষ্ঠির সেনা মধ্যভাগে রইলেন। পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ বিরাটের অনুগমন করলেন। মহাকপি হনুমান এসে অদৃশ্যভাবে অর্জুনের রথের উপর অধিষ্ঠিত হলেন।
দুর্যোধনের বিশাল সৈন্যদল এবং ভীষ্ম দ্বারা সজ্জিত সেনা দেখে যুধিষ্ঠির বিষগ্ন হয়ে অর্জুনকে বললেন, পিতামহ ভীষ্ম যাদের যোদ্ধা তাদের সঙ্গে আমরা কি করে যুদ্ধ করতে পারবো? তিনি যে অভেদ্য সেনাসজ্জা করেছেন তা থেকে কোন্ উপায়ে আমরা নিস্তার পাবো? অর্জুন বললেন, মহারাজ, সত্য, অনিষ্ঠুরতা, ধর্ম ও উদ্যম দ্বারা যে জয়লাভ হয়, বলবীর্য দ্বারা তেমন হয় না। আপনি সর্বপ্রকার অধর্ম ও লোভ ত্যাগ করে নিরহংকার হয়ে উদ্যমী হয়ে যুদ্ধ করুন, যেখানে ধর্ম সেখানেই জয় হবে। আমরা নিশ্চয় জয়ী হবো, কারণ নারদ বলেছেন, যেখানে কৃষ্ণ সেখানেই জয়।
যুধিষ্ঠিরের মাথার উপর হাতির দাঁতের শলাকাযুক্ত সাদা রং-এর ছত্র ধরা হোলো, মহর্ষিরা স্তুতি কোরে তাকে প্রদক্ষিণ করতে লাগলেন। পুরোহিত, ব্রহ্মর্ষি ও সিদ্ধপুরুষগণ শত্রুবধের আশীর্বাদ কোরে স্বস্ত্যয়ন করলেন। যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণগণকে বস্ত্র, গরু, ফল, ফুল ও সোনা দান কোরে ইন্দ্রের ন্যায় যুদ্ধযাত্রা করলেন।
কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, তুমি পবিত্র হয়ে শত্রুর পরাজয়ের জন্য দুর্গাস্তোত্র পাঠ করো। অর্জুন স্তব করলে দুর্গা প্রীত হয়ে অন্তরীক্ষ থেকে অর্জুনকে বললেন, তুমি শীঘ্রই শত্রু জয় করবে, কারণ নারায়ণ তোমার সহায় এবং তুমিও নর-ঋষির অবতার। এই বলে দুর্গা অন্তর্হিত হলেন।
______________
(ক্রমশ)