Looking at Radha. in Bengali Love Stories by Prabhakar Bhangar books and stories PDF | রাধার দিকে চেয়ে।

Featured Books
Categories
Share

রাধার দিকে চেয়ে।


কলকাতার এক সন্ধ্যায়, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের ঝাঁ-চকচকে এক আর্ট গ্যালারিতে বহু বছর পর মুখোমুখি হল ঋত্বিক, ইরা আর সৌরভ। ঋত্বিক, শহরের অন্যতম সেরা স্থপতি, নিজের ডিজাইন করা এক আধুনিক স্থাপত্যের মডেলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ইরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা, পরিচিত সাহিত্যিকদের সাথে আলোচনায় মগ্ন। আর সৌরভ, মঞ্চের জাদুকর, নাটকের নতুন ভাবনা নিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে কথা বলছিল।
তাদের জীবনে আজ সাফল্যের ছোঁয়া, তবু কোথাও যেন একটা পুরনো সুর বেজে উঠছিল। কলেজ জীবনের সেই দিনগুলো, যখন কফি হাউসের ধোঁয়ায় আর নন্দন চত্বরের ঘাসে তাদের স্বপ্নগুলো ডানা মেলত। ঋত্বিকের মনে পড়ছিল ইরার সেই উজ্জ্বল চোখ, কবিতার প্রতি তার মুগ্ধতা। ইরার মনে ভেসে উঠছিল ঋত্বিকের শান্ত মুখ, গভীর চিন্তায় ডুবে থাকা। আর সৌরভের হৃদয়ে আজও অক্ষত ছিল ইরার জন্য সেই না বলা ভালোবাসা, যা চাপা পড়ে গিয়েছিল সময়ের স্রোতে।
একদিন, কলেজ স্ট্রিটের পুরনো কফি হাউসে কফি খেতে খেতে ঋত্বিক আর ইরা পুরনো দিনের কথা বলছিল। তাদের চোখে nostalgia-র ছোঁয়া। ইরা আনমনে বলল, "জানিস তো ঋত্বিক, আমার মনে হয় জীবনটা কেমন যেন...অপূর্ণ থেকে গেল।" ঋত্বিক তার দিকে তাকিয়েছিল, কিন্তু কোনো উত্তর খুঁজে পায়নি। ইরার বিবাহিত জীবন বাইরে থেকে স্বাভাবিক মনে হলেও, ভেতরে একটা শূন্যতা অনুভব করত সে।
অন্যদিকে, সৌরভ তার নতুন নাটক "রাধার দিকে চেয়ে" লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। নাটকের তিনটি চরিত্র— অর্ণব, মেঘনা আর রুদ্র— যেন তাদেরই প্রতিচ্ছবি। অর্ণব, শান্ত স্বভাবের এক শিল্পী; মেঘনা, বুদ্ধিমতী কিন্তু চাপা স্বভাবের এক নারী; আর রুদ্র, আবেগপ্রবণ এক নাট্যকর্মী, যে মেঘনাকে নীরবে ভালোবাসে।
ঋত্বিক বুঝতে পারছিল, ইরার প্রতি তার পুরনো অনুভূতিগুলো আবার জেগে উঠছে। কিন্তু সৌরভ তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। বন্ধুর ভালোবাসার প্রতি সে কি বিশ্বাসঘাতকতা করবে? এই দোলাচলে তার দিন কাটছিল। সৌরভও অনুভব করছিল, ইরা আজও তার হৃদয়ের গভীরে বাস করে। কিন্তু ঋত্বিক আর ইরার মধ্যেকার পুরনো সম্পর্ক তাকে নীরব করে রেখেছিল।
অবশেষে এল সেই নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার রাত। আলো ঝলমলে মঞ্চে "রাধার দিকে চেয়ে" শুরু হল। নাটকের প্রতিটি সংলাপে, প্রতিটি নীরবতায় ঋত্বিক, ইরা আর সৌরভ যেন নিজেদেরই খুঁজে পেল। অর্ণবের নীরব চাওয়া, মেঘনার অব্যক্ত বেদনা, আর রুদ্রের Artist মনের ভালোবাসা— সব যেন তাদের তিনজনের জীবনের প্রতিচ্ছবি।
নাটক শেষ হল। মঞ্চের আলো নিভে গেল, কিন্তু প্রেক্ষাগৃহে পিনপতন নীরবতা। ঋত্বিক দেখল, ইরার চোখে জল। সৌরভের দৃষ্টিও ভিজে। তাদের তিনজনের জীবনে যেন এক নতুন উপলব্ধি জন্ম নিল। কোনো কথা বলার প্রয়োজন ছিল না। "রাধার দিকে চেয়ে" নাটকটি যেন তাদের অব্যক্ত অনুভূতিগুলোকে ভাষা দিয়ে গেল। বাস্তব আর কল্পনার সীমারেখা যেন একাকার হয়ে গেল সেই সন্ধ্যায়। তারা তিনজন নীরবে বসে রইল, তাদের ভেতরের অব্যক্ত আবেগগুলো যেন চোখের জলের ভাষায় কথা বলছিল।

রাত গভীর হলো। আর্ট গ্যালারি থেকে সবাই চলে গেছে, শুধু ঋত্বিক, ইরা আর সৌরভ এখনও বসে আছে। তাদের চারপাশে নীরবতা, কিন্তু সেই নীরবতা যেন হাজারো কথার সমষ্টি। "রাধার দিকে চেয়ে" নাটকটি তাদের নিজেদের জীবনেই এক নতুন পর্দা ফেলেছিল, যেখানে সমাপ্তিটা স্পষ্ট নয়, বরং আরও কিছু প্রশ্ন রেখে গেছে। ঋত্বিক বুঝতে পারছিল, ইরাকে ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আজও তার ভেতর জীবন্ত, কিন্তু সৌরভের আত্মত্যাগ তাকে দ্বিধায় ফেলেছে। ইরা, তার বিবাহিত জীবনের শূন্যতা উপলব্ধি করে, ঋত্বিকের প্রতি তার অনুভূতির গভীরতা নতুন করে আবিষ্কার করেছে। আর সৌরভ, তার না বলা ভালোবাসা নিয়ে, এক অদ্ভুত শান্তির খোঁজে ছিল, যা হয়তো কোনোদিনই পূরণ হবে না।
তিনজনেই জানে, এই গল্পের কোনো সহজ সমাধান নেই। পুরনো প্রেম, বন্ধুত্ব, আর বর্তমানের বাস্তবতা—সবকিছু মিলে এক জটিল গ্রন্থি তৈরি করেছে। কলকাতার এই ব্যস্ত শহর তাদের জীবনের সাক্ষী, কফি হাউসের আড্ডা থেকে নন্দন চত্বরের স্মৃতি। "রাধার দিকে চেয়ে" শুধুমাত্র একটি নাটক ছিল না, এটি ছিল তাদের নিজেদের আত্মার প্রতিচ্ছবি। তারা একে অপরের দিকে তাকাল, চোখে এক অদ্ভুত আলো। এ আলো কি হারানোর বেদনা, না নতুন কিছুর শুরু? তাদের গল্প হয়তো এখানেই শেষ নয়, বরং এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা, যেখানে রাধার দিকে চেয়ে তারা নিজেদের পথ খুঁজে নেবে।