Shadow City in Bengali Short Stories by Prabhakar Bhangar books and stories PDF | ছায়ার শহর

Featured Books
Categories
Share

ছায়ার শহর


প্রথম ভাগ: পরিচিত পথের অপরিচিত পথিক
কলকাতার বুকে সূর্য যখন তার প্রথম আলোর রেখা ফেলে, তখন গঙ্গার ধুলো আর ইট-কাঠের গন্ধ মাখা বাতাস এক অদ্ভুত সজীবতা নিয়ে আসে। এই শহরটা কেবল ইটের স্তূপ আর কংক্রিটের জঙ্গল নয়, এটা যেন এক জীবন্ত সত্তা, যেখানে হাজারো গল্প প্রতিদিন নতুন করে লেখা হয়। অভিজাত ফ্ল্যাটবাড়ির ঝলমলে কাঁচের দেওয়ালে যখন ভোরের আলো ঠিকরে পড়ে, তার ঠিক নিচেই সরু গলি বা ফুটপাথের ছায়ায় তখন আর এক জীবন জেগে ওঠে। এই দুই পৃথিবীর মাঝখানে এক অদৃশ্য দেয়াল, যাকে ছুঁয়ে থেকেও মানুষ একে অপরের কাছে অচেনা।
সঞ্জীব সেনের দিন শুরু হয় এক কাপ কড়া কফির সাথে। বহুতল অফিসের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে তার হাতে ফাইল আর হিসাবে ডুবে থাকা জীবন। কর্পোরেট সিঁড়ি বেয়ে তিনি উপরে উঠেছেন বটে, কিন্তু তার ভেতরের আদর্শবাদী সত্তাটা যেন রোজই একটু একটু করে নুয়ে পড়ছে দুর্নীতির করাল ছায়ায়। "ছায়াপথ আবাসন প্রকল্প" – তার টেবিলে রাখা ফাইলটার দিকে তাকিয়ে সঞ্জীব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই প্রকল্প তাকে দিয়েছে ক্ষমতা, অর্থ, কিন্তু কেড়ে নিচ্ছে তার আত্মসম্মান।
অন্যদিকে, মীরা মন্ডলের সকাল শুরু হয় বস্তির শিশুদের কোলাহলে। শিয়ালদহ স্টেশনের পাশের সেই খুপরি ঘরটা, যেখানে তার "আশার আলো" স্কুল। ছেঁড়া বই, ভাঙা চক আর একরাশ স্বপ্ন নিয়ে রোজ তারা আসে। মীরা নিজেও এই পথেই হেঁটে এসেছে। প্রান্তিক পরিবার থেকে উঠে এসে সে জানে শিক্ষার আলো কতটা জরুরি। তার মনে একটাই জেদ, এই শিশুরা যেন তার মতো শুধু বেঁচে থাকার জন্য লড়াই না করে, মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখে।
ভোরের ঠান্ডা হাওয়ায় গগন ঘোষের চায়ের দোকানের ধোঁয়া উঁচিয়ে ওঠে। ফুটপাথের এক কোণে ছোট্ট তার চায়ের দোকান, যেখানে চা খেতে খেতে দিনমজুর থেকে শুরু করে সাহেব-সুবা, সবাই দু’দণ্ড জিরিয়ে নেয়। গগনের চোখে তার ছেলের ভবিষ্যৎ। সে স্বপ্ন দেখে, তার ছেলে একদিন তার মতো ফুটপাথে চা বিক্রি করবে না, স্যুট-বুট পরে সাহেবের মতো কাজ করবে। এই স্বপ্নই তার জীবনের একমাত্র পুঁজি।
রুবি, নামকরা ফ্যাশন হাউসের উজ্জ্বল মুখ। ক্যামেরার ফ্ল্যাশে তার হাসিটা ঝলমলে, কিন্তু ভেতরের শূন্যতাটা কেবল সে নিজেই জানে। তার অতীতটা এক গোপন কুঠুরিতে তালাবন্ধ। মডেলিং-এর চাকচিক্য তাকে সাময়িক তৃপ্তি দেয় বটে, কিন্তু তার আত্মা যেন সারাক্ষণ এক গভীর শূন্যতায় ভোগে। সে জানে, এই আপাত সফলতার আড়ালে লুকিয়ে আছে একাকীত্ব আর এক চাপা কষ্ট।
আর চরণ দাস? শহরের প্রতিটি রাস্তা তার চেনা। তার রিকশার টায়ারের ঘর্ষণে কলকাতার রাস্তা যেন তার জীবনের গল্প বলে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্যাডেল করে চলেছেন তিনি, কিন্তু জীবনের গন্তব্যটা যেন আজও অজানা। রিকশার চাকায় ঘুরতে ঘুরতে তিনি দেখেন কত জীবন, কত গল্প। কেউ ধনী, কেউ গরীব, কেউ সুখে আছে, কেউ কষ্টে। কিন্তু সবার জীবনই যেন এক অবিরাম যাত্রা, যার শেষ কোথায়, তা কেউ জানে না।
এভাবেই চলছিল কলকাতার জীবন। সঞ্জীবের অফিসের লিফটে হয়তো কোনোদিন মীরার কোনো পরিচিত উঠে গেছে, গগনের দোকানে চা খেতে গিয়ে হয়তো কোনো রিকশাচালক চরণ দাসের সাথে গল্প করেছে, রুবি হয়তো কোনো ফটোশুটের জন্য সেই রাস্তা দিয়ে গিয়েছে যেখানে চরণ দাস রিকশা চালাচ্ছেন। তাদের জীবনগুলো আলাদা হলেও, শহরের অদৃশ্য সুতোয় তারা যেন কোথাও না কোথাও বাঁধা। একটি হাসপাতাল, একটি রাস্তার মোড়, একটি স্কুল বা এক সাধারণ বাজারে – রোজই তাদের জীবন একে অপরকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল, যদিও তারা একে অপরের কাছে ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত।
উপসংহার
"ছায়ার শহর" উপন্যাসের শেষে, কলকাতার বুকে সূর্যাস্তের এক লাল আভা নেমে আসে। ধসের ধ্বংসস্তূপের উপর নতুন করে গড়ে ওঠা এক আশার চিহ্ন দেখা যায়। এই বিপর্যয়, যা তাদের বিচ্ছিন্ন জীবনকে এক বিন্দুতে এনেছিল, শেষ পর্যন্ত তাদের ভেতরের প্রকৃত মানবতাকে জাগিয়ে তোলে। সঞ্জীব সেন, যিনি একসময় দুর্নীতির জালে আটকে গিয়েছিলেন, এখন একজন সৎ ও নির্ভীক কর্মী। তিনি তার চাকরি হারানোর বেদনাকে পেছনে ফেলে নতুন করে এক স্বচ্ছ ব্যবস্থার জন্য লড়াই শুরু করেছেন। তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মীরা মন্ডল এবং গগন ঘোষ, যারা সমাজের প্রান্তিক মানুষদের জন্য নিরলস কাজ করে চলেছেন। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়, ধসে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো শুধু সাহায্যই পায় না, বরং মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে।
রুবি, যে নিজের ভেতরের শূন্যতা নিয়ে একাকী ছিল, মিডিয়ার মাধ্যমে ঘটনাটি সামনে এনে সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। তার এই পদক্ষেপ কেবল তার নিজের ভেতরের অন্ধকারকেই দূর করে না, বরং তাকে নতুন এক জীবনের দিশা দেখায় – যেখানে খ্যাতি নয়, মানুষের জন্য কিছু করাই তার মূল লক্ষ্য। চরণ দাস, যিনি একসময় জীবনের গন্তব্যহীন পথিক ছিলেন, তিনি এখন এই নবগঠিত জোটের একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তার রিকশার প্যাডেল এখন কেবল শরীর নয়, সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতাও বহন করে। তিনি শহরের প্রতিটি কোণ থেকে সাহায্য পৌঁছে দেন, মানুষের পাশে দাঁড়ান।
শহরের ভাঙাচোরা রূপের মধ্যেও গড়ে ওঠে এক নতুন জোট – যেখানে মানুষ শ্রেণি, ধর্ম, অর্থ না দেখে একে অপরের সাহায্য করতে শেখে। অভিজাত ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দারা বস্তির ফুটপাতবাসীদের হাত ধরে। তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে এক অভূতপূর্ব সংহতি। "ছায়ার শহর" শেষ হয় এক আশার আলো নিয়ে। শহরের আকাশে যখন রাতের তারা জ্বলে ওঠে, তখন মনে হয় এই তারারা যেন শুধু আকাশেই নয়, মানুষের মনেও এক নতুন আলোর জন্ম দিয়েছে। সমাজের সকল স্তরের মানুষ একটু করে বদলায়। তারা বুঝতে পারে, আসল শহর ইঁটের তৈরি নয়, মানুষের হৃদয়ের ভালোবাসায় তৈরি। আর সেই ভালোবাসাই পারে সব অন্ধকার দূর করে এক নতুন ভোরের জন্ম দিতে।
ছায়ার শহর" শুধু কলকাতার গল্প নয়, প্রতিটি শহরের গল্প—যেখানে শ্রেণিবৈষম্য, দুর্নীতি, ভোগবাদ, আর আত্মপরিচয়ের টানাপোড়েন।
কিন্তু এই গল্পের শেষ আশার আলোয়—
যেখানে মানুষ বদলায়, সমাজ বদলায়,
আর ছায়ার মধ্যেও জন্ম নেয় নতুন সূর্য।
পরিবর্তনের শুরু হয় ব্যক্তি থেকে,
আর শেষ হয় সকলের একতায়।
এই শহর, এই জীবন—শেষ পর্যন্ত, মানবিকতারই জয়।