অরিন্দম, মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেটি, তার জীবন চালাতো ইংরেজির টিউশন পড়িয়ে। শান্ত স্বভাবের অরিন্দমের একমাত্র দৃঢ়তা ছিল তার ভালোবাসা। অন্যদিকে, সাহানা ছিল উচ্চবিত্ত পরিবারের একমাত্র মেয়ে। স্বাধীনচেতা হলেও, তার জীবন বাঁধা ছিল পরিবারের কড়া নিয়মের বেড়াজালে। তাদের প্রথম দেখা এক টিউশন ক্লাসে। শুরুটা ছিল নিছকই পড়াশোনার, কিন্তু বইয়ের পাতার ফাঁকে কখন যে দুটি মন এক সুতোয় বাঁধা পড়ল, তা তারা নিজেরাও বুঝে উঠতে পারেনি। সাহানা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিল, তার জীবনের আসল শান্তি লুকিয়ে আছে অরিন্দমের নিষ্পাপ ভালোবাসার মধ্যে।
তাদের ভালোবাসার সুতো যখন আরও মজবুত হচ্ছিল, তখনই এলো সেই কঠিন সত্য। সাহানার পরিবার তার বিয়ে ঠিক করে ফেলল সুদীপনের সাথে, এক ধনী ব্যবসায়ীর ছেলে। সাহানা স্পষ্ট জানিয়ে দিল সে এই বিয়ে চায় না, তার মন অরিন্দমের জন্য। কিন্তু পরিবারের একটাই কথা, "ভালোবাসা দিয়ে সংসার হয় না, টাকাপয়সা লাগে। অরিন্দম একজন সামান্য টিউশন মাস্টার, সে তোমাকে কী দেবে?"
অরিন্দমও কম যায়নি। সাহানার বাড়িতে গিয়ে সাহানার হাত চাইল সে। কিন্তু বিনিময়ে জুটল শুধু অপমান। সাহানার মা, মিসেস সেনগুপ্ত কড়া গলায় বললেন, "তুমি একটা টিউশনি মাস্টার, সাহানাকে তুমি সামলাতে পারবে না!" সেদিনই অরিন্দম সিদ্ধান্ত নিল, "সাহানাকে আমি হারাতে পারবো না।"
অরিন্দম তার বন্ধু রবিকে নিয়ে এক পরিকল্পনা সাজাল। রবি ছিল অরিন্দমের ডান হাত, দুঃসময়ের সাথী। সাহানার সাথে গোপনে যোগাযোগ করা হলো। ঠিক হলো, বিয়ের আগের দিন রাতেই পালাবে তারা। উত্তেজনা আর ভয় মেশানো এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পড়ল তিনটি মন – অরিন্দম, সাহানা আর রবি।
বিয়ের আগের রাত। ঘড়িতে তখন রাত ২টা। সাহানা ধীর পায়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বুকের ভেতর এক অজানা ঢেউ। জানালার রড ধরে সজোরে টান দিল। কঠিন লোহার রডগুলো সামান্য বাঁকতেই সাহানার মনে হলো যেন তার জীবনেও মুক্তির আলো ঝলমল করছে। ধীরে ধীরে রড ভেঙে বাইরে এলো সে। নিচে, রাস্তার ওপর নীরবে অপেক্ষা করছে অরিন্দমের গাড়ি। রবি ড্রাইভিং সিটে।
গাড়ি ছুটতে শুরু করল। পেছনে রেখে এলো সাহানা তার বিলাসবহুল জীবন, কঠোর নিয়মের বেড়াজাল আর পরিবারিক সম্মান। অরিন্দম জানত এই পালানোর পরিণতি কী হতে পারে, কিন্তু সাহানাকে হারানোর চেয়ে তা কিছুই ছিল না। রাত যত বাড়ছিল, তাদের গাড়ির গতিও তত বাড়ছিল। পেছনে ধাওয়া করছে সাহানার পরিবারের পাঠানো লোক। রাস্তা জুড়ে ধাওয়া, বাধা, উত্তেজনা... প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল এই বুঝি সব শেষ। কিন্তু অরিন্দম আর সাহানার চোখে ছিল এক অদম্য জেদ, ভালোবাসার জন্য সবকিছু জয় করার জেদ।
একসময় তারা পৌঁছে গেল এক ছোট্ট মন্দিরে। শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে, নির্জন সেই মন্দিরে এক পুরোহিতকে ডেকে আনা হলো। কোনো আড়ম্বর ছাড়াই, সামান্য আলো-আঁধারিতে অরিন্দম আর সাহানা একে অপরের হাত ধরল। মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে তারা নতুন জীবনের শপথ নিল। ভালোবাসায় পূর্ণ এই বিয়ে, হয়তো সামাজিক রীতি-নীতি মেনে হয়নি, কিন্তু এর পবিত্রতা ছিল অনবদ্য। সেই রাতে তারা বুঝল, ভালোবাসা শুধু দুটি মানুষকে নয়, দুটি আত্মাকে মিলিয়ে দেয়।
দশ বছর পর...
একটা ছোট্ট বাড়ি। বাড়ির সামনে এক টুকরো সবুজ বাগান। সেখানে খেলা করছে একটা ছোট্ট মেয়ে, তাদের ভালোবাসার ফসল। বারান্দায় বসে আছে সাহানা আর অরিন্দম। অরিন্দমের মুখে সেই পুরনো শান্ত হাসি, চোখে আত্মতৃপ্তি। সে এখন একটি ছোট স্কুলের হেডমাস্টার। সাহানা পাশে বসে হাসছে। সে নিজেই এক বুটিক চালায়, নিজের হাতে তৈরি পোশাক বিক্রি করে।
তাদের কাছে হয়তো আজও টাকাপয়সা নেই খুব বেশি। বিলাসবহুল জীবন তাদের কাছে অধরা। কিন্তু তাদের চোখেমুখে যে তৃপ্তি, যে আনন্দ আর যে অঢেল ভালোবাসা, তা পৃথিবীর কোনো অর্থের বিনিময়ে কেনা যায় না। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসে। পথ হয়তো অনেক কঠিন ছিল, কিন্তু ভালোবাসার জোরে তারা সব বাধা পেরিয়ে এসেছে। তাদের গল্পটা হয়তো রূপকথার মতো নয়, কিন্তু সত্যিকারের ভালোবাসার এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
অরিন্দম আর সাহানার গল্পটা শুধুমাত্র ভালোবাসার নয়, এটা ভালোবাসার জন্য লড়াইয়ের গল্প। সমাজের চাপ, পরিবারের অমত, আর্থিক অনিশ্চয়তা—সবকিছুকে তুচ্ছ করে তারা নিজেদের পথ তৈরি করে নিয়েছে। তাদের জীবনে হয়তো প্রাচুর্য আসেনি, কিন্তু এসেছে এক অনাবিল শান্তি আর তৃপ্তি। তারা প্রমাণ করেছে, সত্যিকারের ভালোবাসা যেকোনো বাধাকে অতিক্রম করতে পারে এবং ভালোবাসার শক্তিতে গড়া সম্পর্কই সবচেয়ে মজবুত হয়।
ভালোবাসা মানে শুধু একসাথে থাকা নয়, ভালোবাসা মানে একে অপরের পাশে থাকা, একে অপরের স্বপ্নকে সম্মান জানানো এবং সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে একসাথে রুখে দাঁড়ানো। জীবনের আসল সুখ টাকাপয়সায় বা সামাজিক প্রতিষ্ঠায় নয়, বরং নিহিত আছে সম্পর্কের গভীরতায় আর আন্তরিক ভালোবাসায়। যখন ভালোবাসা আর আত্মবিশ্বাস থাকে, তখন যেকোনো সাধারণ জীবনও অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে। ভালোবাসুন মন খুলে, বাঁচুন নিজের মতো করে!