কলকাতার এক পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে প্রথম দেখা হয়েছিল অরিত্র আর তিয়াসার। দুজনেই ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র, কিন্তু প্রথম দেখাতেই যেন একটা অদৃশ্য প্রাচীর তৈরি হয়েছিল দুজনের মাঝে। অরিত্র ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী ছেলে, স্বপ্ন দেখতো বড় লেখক হওয়ার। গিটার বাজাতো আর সারাক্ষণ বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকতো। অন্যদিকে, তিয়াসা ছিল ধনী পরিবারের মেয়ে, যার জীবনে সবকিছু সহজে এলেও ভালোবাসার অনুভবটা অধরাই ছিল। সে ছিল সংবেদনশীল আর অন্তর্মুখী।
প্রথমদিকে তাদের সম্পর্কটা ছিল অনেকটা উত্তর-দক্ষিণের মতো। ক্লাসের বিতর্কে একে অপরের বিরোধিতা করতো, সাহিত্যের ব্যাখ্যায় মতের অমিল লেগেই থাকত। অরিত্রর চোখে তিয়াসা ছিল জেদি আর উদ্ধত, আর তিয়াসার কাছে অরিত্র ছিল অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, এই মতের অমিলগুলোই ধীরে ধীরে তাদের কাছাকাছি এনেছিল। ক্লাসের পর লাইব্রেরিতে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত কবিতা আর সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে করতে। রবি ঠাকুরের কবিতা থেকে শুরু করে শেক্সপীয়রের সনেট, সবকিছু নিয়েই চলতো তাদের শব্দহীন কথোপকথন। তিয়াসা ধীরে ধীরে মুগ্ধ হতে লাগলো অরিত্রর সরলতা, তার স্পষ্টবাদিতা আর নিজের স্বপ্ন পূরণের দৃঢ়তা দেখে। অরিত্র প্রথমে দ্বিধায় থাকলেও, তিয়াসার স্পর্শকাতর মন আর গভীর চিন্তাভাবনা তাকে টানতে শুরু করলো। একসময় সে বুঝতে পারলো, তিয়াসাই তার জীবনের সেই সত্যিকারের অনুভব, যা এতদিন শুধু বইয়ের পাতায় খুঁজেছিল।
তারা প্রেমে পড়লো। তাদের প্রেমটা ছিল অনেকটা ছায়ার মতো, শব্দহীন কিন্তু গভীর। জনসমক্ষে তাদের প্রেম নিয়ে কোনো উচ্ছ্বাস ছিল না, ছিল শুধু একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা আর হাতে হাত রেখে হেঁটে যাওয়া। তাদের ভালোবাসা ছিল তাদের ব্যক্তিগত এক শিল্প, যা শুধু তারাই অনুভব করতে পারতো।
কিন্তু এই নিভৃত ভালোবাসার বাঁধ ভেঙে গেল যখন তিয়াসার পরিবার তার জন্য একজন ধনী পাত্র খুঁজে পেল। তিয়াসার পরিবার অরিত্রর মতো ‘অর্থহীন’ ছেলেকে মেনে নিতে রাজি ছিল না। তিয়াসা প্রতিবাদ করেছিল, কেঁদেছিল, অনুনয় করেছিল, কিন্তু তার পরিবার তাকে মানসিকভাবে ভেঙে চুরমার করে দিল। ভালোবাসার চেয়ে অর্থ আর সামাজিক প্রতিষ্ঠার কাছে হার মানতে হলো তিয়াসাকে।
এক মেঘলা দুপুরে অরিত্র তিয়াসার হাত ধরে বসেছিল কলেজ ক্যান্টিনের কোণায়। অরিত্রর চোখগুলো ছিল ভিজে, তার কণ্ঠে ছিল এক অচেনা দৃঢ়তা। সে তিয়াসাকে বললো, “তুমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করো, তিয়াসা। আমি চাই না আমার জন্য তোমার কোনো স্বপ্ন অপূর্ণ থাক।” অরিত্রর এই কথা তিয়াসাকে আরও ভেঙে দিল। সে চেয়েছিল অরিত্র তাকে ধরে রাখুক, পালিয়ে যাওয়ার কথা বলুক। কিন্তু অরিত্র তাকে ভালোবাসার নামে মুক্তি দিল। তিয়াসা জানতো, অরিত্রর এই সিদ্ধান্ত তার নিজের জন্য কষ্টের হলেও, তিয়াসার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই সে এমনটা বলেছিল। ভাঙা মন নিয়ে হলেও, তিয়াসা অরিত্রর কথা মেনে নিল।
তিয়াসার বিয়ে হয়ে গেল অন্য কারো সাথে। বিয়ের দিন সকালে অরিত্রর ফেলে যাওয়া প্রিয় বইয়ের ভাঁজে সে একটা চিঠি রেখে গিয়েছিল:
“তুই যদি বলতি, আমি পালিয়ে যেতাম… কিন্তু তুই ভালোবাসার নামে আমাকে মুক্তি দিলি। তাই ভালো থাকিস, তোর লেখার মধ্যে আমি চিরকাল বেঁচে থাকব।”
চিঠিটা পড়ে অরিত্র অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিল। তারপর একটা দীর্ঘ, নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙে পড়েছিল সে। তার ভালোবাসার মানুষটা অন্যের হয়ে গেল, আর সে কিছুই করতে পারলো না।
বহু বছর কেটে গেছে। অরিত্র এখন একজন নামী লেখক। তার লেখা বইগুলো বেস্টসেলার, তার সাহিত্যকর্ম তাকে এনে দিয়েছে দেশজোড়া খ্যাতি। কিন্তু সে কোনোদিন বিয়ে করেনি। তার প্রতিটি উপন্যাসে, প্রতিটি কবিতায় একটা চরিত্র ঘুরে ফেরে—নাম ‘তিয়াসা’। সেই চরিত্রটি হয় নিভৃত, গভীর আর চিরঅতৃপ্ত। পাঠকের চোখে সেই চরিত্রগুলো শুধু কল্পনার হলেও, অরিত্র জানতো, তারা আসলে তার অসম্পূর্ণ ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি।
এই গল্প আমাদের শেখায়, সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না। কিছু ভালোবাসা অসম্পূর্ণই থেকে যায়। কিন্তু সেই অসম্পূর্ণ ভালোবাসাই হয় সবচেয়ে গভীর, সবচেয়ে চিরন্তন, যা সারা জীবন মনের গভীরে থেকে যায় এক অমলিন স্মৃতি হয়ে।
অরিত্রর জীবনে তিয়াসা এখন কেবল এক স্মৃতি নয়, সে তার শিল্পের অনুপ্রেরণা। প্রতিটি নতুন সৃষ্টিতে তিয়াসার ছায়া খুঁজে ফেরা অরিত্র প্রমাণ করে দেয়, কিছু ভালোবাসা সত্যিই অমর। সময়ের স্রোতে অনেক কিছু বদলে গেলেও, অরিত্রর হৃদয়ের গভীরে তিয়াসার স্থানটি অটুট রয়ে গেছে। সে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো জীবনে হয়তো ‘পূর্ণতা’ পায়নি, কিন্তু তার অপূর্ণ ভালোবাসা তাকে এক অসাধারণ শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলেছে। অরিত্রর নীরব ত্যাগ আর তিয়াসার রেখে যাওয়া চিঠি – এই দুয়ে মিলে এক গভীর বেদনার জন্ম দিয়েছে, যা অরিত্রর লেখার প্রতিটি ছত্রে জীবন্ত। এই নীরবতা, এই অপূর্ণতাই যেন তাদের ভালোবাসাকে আরও মহিমান্বিত করেছে।
সব ভালোবাসাই যে বিয়ের মতো সামাজিক বন্ধনে পূর্ণতা পায়, এমনটা নয়। বরং কিছু ভালোবাসা তার অপূর্ণতার মধ্যেই সবচেয়ে বেশি গভীরতা খুঁজে পায়। অরিত্র আর তিয়াসার গল্প আমাদের শেখায় যে, ভালোবাসার সংজ্ঞা শুধু পাশে থাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ভালোবাসার মানুষটির ভালোর জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার মধ্যেও এক অনবদ্য সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। এই গল্প প্রমাণ করে, শারীরিক বিচ্ছেদ ঘটলেও সত্যিকারের ভালোবাসা কখনো মরে না; বরং তা শিল্প, স্মৃতি আর অনুভূতির মাধ্যমে অমর হয়ে থাকে। যে ভালোবাসা অপূর্ণ থাকে, সেটাই হয়তো সময়ের সীমানা পেরিয়ে চিরন্তন হয়ে ওঠে।