অধ্যায় ৫: ছায়ার দেবতা
তারা পৌঁছায় এক পরিত্যক্ত দুর্গে—রাজ্যপথের শেষ প্রান্তে, যেখানে মানুষ বহু বছর ধরে পা রাখেনি। কায়ান জানত এই জায়গার নাম—“ভ্রাতমন্ডল”। এক সময় এটি ছিল উপাসনার কেন্দ্র, যেখানে রাজবংশ গোপনে সেই অশুভ দেবতাকে পূজা করত।
প্রাসাদের দেয়ালজুড়ে এখনো ছাপ রয়ে গেছে সেই পুরনো আঁকা ছবির—অর্ধেক মানব, অর্ধেক ছায়া এক দেবতা, যার হাতে চাবি, চোখে শূন্যতা।
এলিয়া ধীরে ধীরে প্রাচীন ফটক ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে।
হঠাৎ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। চারদিকে ছায়া নড়তে শুরু করে। মাটির নিচ থেকে যেন উঠে আসে ফিসফিসে কণ্ঠস্বর—
“তুমি এসেছো… রক্তচোখের কন্যা… আমার উত্তরাধিকার...”
এলিয়ার চোখ লাল হয়ে ওঠে, আবারও।
কায়ান তার পাশে দাঁড়িয়ে, তরবারি বের করে। যদিও সে জানে, এই যুদ্ধ শুধুই অস্ত্র দিয়ে জেতা যাবে না।
তাদের সামনে আবির্ভূত হয় এক বিশাল ছায়া-মূর্তি। তার মুখ নেই, শুধু এক কালো গহ্বর; তার শরীর ধোঁয়ার মতো, ছায়ার মতো।
“আমি ভ্রাত,” ছায়া বলে। “এবং আমি এখনও তোমাদের মধ্যেই বাস করি।”
হঠাৎ করেই কায়ানের শরীর কাঁপতে শুরু করে। তার চোখ কালো হয়ে যাচ্ছে, গলার স্বর বদলে যাচ্ছে।
এলিয়া চিৎকার করে ওঠে, “না! তুমি ওর দাস হতে পারো না!”
ভ্রাত হেসে ওঠে, “সে আমার রক্তে জন্মানো। আমি তার ভেতরেই ঘুমিয়ে ছিলাম। এখন সময় এসেছে... জেগে ওঠার।”
এলিয়া এগিয়ে আসে কায়ানের দিকে, আর কিছু না ভেবে তাকে জড়িয়ে ধরে। সেই বন্ধনের উষ্ণতায় কায়ান এক মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। তার চোখের কালো আলো কমে আসে।
“তুমি যদি আলো হতে পারো,” এলিয়া বলে, **“তাহলে আমি তোমার অন্ধকারও গ্রহণ কর।
অধ্যায় ৬: বিভ্রমের জাল
চারপাশ যেন অদৃশ্য কোনো ধাক্কায় উল্টে গেল। কায়ান ও এলিয়া একসাথে ভ্রাতের রূপ থেকে ছড়ানো অশুভ শক্তির আঘাতে ধপ করে পড়ে যায় মাটিতে। কিন্তু মাটি যেন আর মাটি ছিল না। মুহূর্তেই চারদিক বদলে যায়।
এলিয়া চোখ মেলে দেখে, সে এখন মিরাল গ্রামে নয়। নয় কোনো পুরনো দুর্গেও।
সে এক উজ্জ্বল সকালে দাঁড়িয়ে আছে। পাশের ছোট্ট ঘরের জানালা দিয়ে দুধ-রঙা আলো ঢুকছে, আর তার মা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কোমল হাসি দিয়ে বলছেন—
“এলিয়া, আজ স্কুলে দেরি হয়ে যাবে। জলখাবার খেয়ে বেরো। আমি তোর প্রিয় পিঠা বানিয়েছি।”
তার মা?
এলিয়া স্তম্ভিত। সে নিজের ছোট হাত দুটো দেখে। সে আবার সেই দশ বছরের বাচ্চা!
"না... এটা বাস্তব নয়," সে ফিসফিস করে। "আমি তো... আমি বড় হয়েছি... আমি তো এখন..."
কিন্তু চারপাশের দৃশ্য এতটাই জীবন্ত, এতটাই সত্যি যে তার হৃদয়ের গভীরতম ব্যথাকে নাড়িয়ে দেয়।
সে শুনতে পায় পেছনে পায়রার ডাক, দুধ গরম হওয়ার শব্দ, মায়ের কণ্ঠে সেই চিরপরিচিত গান। চোখে জল চলে আসে।
“তুই থাক এখানে, এলিয়া,” এক অদৃশ্য কণ্ঠ বলে, “এই সুখের বিভ্রমেই থাক। বাস্তব তো শুধু যুদ্ধ আর মৃত্যু।”
এদিকে কায়ান এক সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতে।
সে নিজেকে দেখে রাজসিংহাসনে বসে। হাতে রাজদণ্ড, পায়ে হাত রাখছে প্রজারা। চারদিক ঝলমলে আলোয় ভরা। রাজপুরী উৎসবমুখর। তার চারপাশে হাসিমুখ, গর্বিত কণ্ঠস্বর, রাজা হিসেবে তার জয়গান।
কিন্তু হঠাৎ কেউ ফিসফিস করে ওঠে, “এটাই তো চেয়েছিলে কায়ান, তাই না? ক্ষমতা, সম্মান, অমরত্ব? এই নাও, নিয়ে নাও সব। শুধু... নিজের সত্য ভুলে যাও।”
কায়ান স্তব্ধ হয়ে তাকায়।
এই স্বপ্নময় রাজত্বে তার কোনো অনুভব নেই। সেখানে আলো আছে, কিন্তু উষ্ণতা নেই। গর্ব আছে, কিন্তু আত্মা নেই।
তখনই দূর থেকে ভেসে আসে এক গলা—একান্ত পরিচিত, কোমল, দৃঢ়—
“তুমি এর চেয়ে অনেক বেশি কায়ান। তুমি শুধু রক্ত নয়। তুমি আমার বিশ্বাস।”
এলিয়ার কণ্ঠ!
কায়ানের মুখে অদ্ভুত আলো ফুটে ওঠে। সে দাঁড়িয়ে পড়ে। চারপাশের বিভ্রম ভেঙে যেতে থাকে একে একে।
"না," সে বলে, "আমি এই ধোঁয়ায় তৈরি মুকুট চাই না। আমি চাই সত্য। আমি চাই আমার যুদ্ধ, আমার ভালোবাসা।"
---
এদিকে এলিয়াও মায়ের মুখে তাকিয়ে বলে,
“তুমি যদি আমার মা হও, তবে তুমি চাইবে আমি সত্য জানি। আমি এখানে থাকলে রাজ্য পঁচে মরবে। আমার দায়িত্ব আছে, আমার লড়াই আছে।”
মায়ের ছায়া হেসে ওঠে।
“ঠিক বলেছিস, মা। আমি তো তোরই আত্মার অংশ। তুই এখন জানিস কে তুই।”
পট করে চারপাশ ঘুরে যায়। মায়ের ঘর অদৃশ্য হয়।
---
একই সময়ে, কায়ান ও এলিয়া ফিরে আসে বাস্তবে।
তারা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। দুজনের দেহ ক্লান্ত, কিন্তু চোখ জ্বলছে।
ভ্রাত ছায়ার আকারে তাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোমরা... বিভ্রম ভেঙে ফেললে? অসম্ভব! এই প্রথম কেউ… আমার জাল থেকে ফিরল!”
এলিয়া ধীরে কায়ানের হাত ধরে।
“আমরা ফিরেছি, কারণ আমরা নিজেরাই নিজেদের খুঁজে পেয়েছি,” সে বলে।
“তুমি যতই ছায়া তৈরি করো, আমরা আলো খুঁজে নেব।
তুমি যতই স্মৃতি দিয়ে আটকাতে চাও, আমরা ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাব।”
ভ্রাত এবার হিংস্রভাবে গর্জে ওঠে।
“তাহলে প্রস্তুত হও... শেষ যুদ্ধের জন্য!”
আকাশে বজ্রপাত হয়।
রাজ্যের বুকের নিচে কাঁপন শুরু হয়।
এই অধ্যায়ে এলিয়া ও কায়ান কেবল অন্ধকার থেকে ফিরে আসেনি, নিজেদের ভেতরের বিভ্রম ও লোভকেও জয় করেছে। তাদের আত্মপরিচয়ের পথে এটি এক মহৎ বিজয়—যেখানে আলোর শক্তি তৈরি হয় ভেতর থেকে।