Story of Mahabharat Part 129 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 129

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 129

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১২৯

অর্জুন কর্তৃক জয়দ্রথ বধের প্রতিজ্ঞার কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

অর্জুন কর্তৃক জয়দ্রথ বধের প্রতিজ্ঞার কাহিনি

অভিমন্যু নিহত হওয়ার দিন সন্ধ্যায় দুʼপক্ষের সৈন্য যুদ্ধ থেকে বিরত হওয়ার পর আর অর্জুন সংশপ্তকগণকে বধ কোরে নিজেদের শিবিরে ফিরে চললেন। তিনি যেতে যেতে উদ্বিগ্ন হয়ে কৃষ্ণকে বললেন, আমার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে, শরীর অবসন্ন হচ্ছে, বহু অশুভ লক্ষণ দেখছি। আমার ভাইয়েরা কুশলে আছে তো? কৃষ্ণ বললেন, তুমি চিন্তিত হয়ো না, তারা ভালই আছেন।

নিরানন্দ অন্ধকার শিবিরে উপস্থিত হয়ে অর্জুন দেখলেন, কোনো মাঙ্গলিক বাদ্য বাজছে না, শঙ্খধ্বনি হচ্ছে না, ভাইয়েরা যেন অচেতন হয়ে রয়েছেন। উদ্বিগ্ন হয়ে অর্জুন তাদের বললেন, তোমরা সকলে বিষণ্ণ কেনো, অভিমন্যুকেও দেখছি না। শুনেছি দ্রোণ চক্রব্যূহ রচনা করেছিলেন, অভিমন্যু ভিন্ন আপনাদের আর কেউ তা ভেদ করতে পারেন না। কিন্তু তাকে আমি প্রবেশ করতেই শিখিয়েছি, বেরিয়ে আসার কৌশল শেখাইনি। ব্যূহের মধ্যে প্রবেশ কোরে অভিমন্যু কি নিহত হয়েছে? সুভদ্রার প্রিয় পুত্র, দ্রৌপদী, কৃষ্ণ ও আমার স্নেহভাজন অভিমন্যুকে কে বধ করেছে? আমার সর্বগুণান্বিত পুত্র, যে মহারথ বলে গণ্য, যার বিক্রম অতুলনীয়, যে কৃষ্ণ, প্রদ্যুম্ন ও আমার প্রিয় শিষ্য, সেই পুত্রকে যদি দেখতে না পাই তবে আমি যমলোকে যাবো। হা পুত্র, আমি ভাগ্যহীন তাই তোমাকে সর্বদা দেখেও আমার তৃপ্তি হোতো না। তুমি সম্মুখ সমরে নিহত হয়ে দেবলোকে গিয়েছ, তুমি দেবগণের প্রিয় অতিথি হয়েছ।

তারপর অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, অভিমন্যু শত্রুনিপীড়ন করে সম্মুখ যুদ্ধে স্বর্গারোহণ করেছে তো? কর্ণ, দ্রোণ প্রভৃতির বাণে কাতর হয়ে সে হয়তো বার বার বলেছে — যদি পিতা এসে আমাকে রক্ষা করতেন! সেই অবস্থায় নৃশংসগণ তাকে নিপাতিত করেছে। কিন্তু, যে আমার পুত্র, কৃষ্ণের ভাগিনেয়, সুভদ্রার গর্ভজাত, সে নিশ্চয়ই এমন বিলাপ করতে পারে না। তাকে না দেখে সুভদ্রা আর দ্রৌপদী কি বলবে, আমিই বা তাদের কি বলবো? আমার হৃদয় নিশ্চয় বজ্রের মতো কঠিন, শোকার্তা বধু উত্তরার কান্নাতেও তা বিদীর্ণ হবে না। আমি গর্বিত ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণের গর্জন শুনেছিলাম, কৃষ্ণও যুযুৎসুকে বলতে শুনেছেন — অধর্মজ্ঞ মহারথেরা অর্জুনের পরিবর্তে একটি বালককে বধ কোরে চিৎকার করছ কেন?

পুত্র শোকে কাতর অর্জুনকে ধরে কৃষ্ণ বললেন, শান্ত হও, সকল ক্ষত্রিয় বীরেরই এই পরিণতি। অভিমন্যু দেবলোকে গেছে তাতে সন্দেহ নেই। সকল বীরেরই আকাঙ্ক্ষা যেন সম্মুখ যুদ্ধে আমার মৃত্যু হয়। অর্জুন, তোমাকে শোকাবিষ্ট দেখে তোমার ভাইয়েরা, এই রাজারা, এবং সুহৃদ্গণ সকলেই কাতর হয়েছেন। তুমি সান্ত্বনা দিয়ে এঁদের আশ্বস্ত করো, তুমি শোক কোরো না।

রুদ্ধকণ্ঠে অর্জুন ভাইদের বললেন, অভিমন্যুর মৃত্যু কি কোরে হোলো আমি শুনতে চাই। আপনারা রথারোহী হয়ে শরবর্ষণ করছিলেন, শত্রুরা অন্যায় যুদ্ধে কি কোরে তাকে বধ করলো? হায়, আপনাদের পৌরুষ নেই, পরাক্রমও নেই। আমারই দোষ, তাই দুর্বল ভীরু আপনাদের উপর ভার দিয়ে অন্যত্র গিয়েছিলাম। আপনাদের বর্ম আর অস্ত্রশস্ত্র অলংকারমাত্র, সভায় যে বীরত্ব প্রকাশ করতেন তাও কেবল মুখের কথা, তাই আমার পুত্রকে রক্ষা করতে পারলেন না। এই বলে অর্জুন ক্রুদ্ধ হয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন।

যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, তুমি সংশপ্তকদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলে দ্রোণ তার সৈন্যদের ব্যূহবদ্ধ করে আমাদের নিপীড়িত করতে লাগলেন। নিরূপায় হয়ে আমরা অভিমন্যুকে বললাম, তুমি দ্রোণের সৈন্য ভেদ করো। যে পথে সে ব্যূহমধ্যে প্রবেশ করবে সেই পথে আমরাও যাবো এই ইচ্ছায় আমরা তার অনুসরণ করলাম, কিন্তু জয়দ্রথ মহাদেবের বরে আমাদের সকলকেই বাধা দিলেন। তার পর দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, বৃহদ্বল ও কৃতবর্মা এই ছয় রথী অভিমন্যুকে ঘিরে ধরলেন। বালক অভিমন্যু যথাশক্তি যুদ্ধ করতে লাগল, কিন্তু অবশেষে তার রথ নষ্ট হল, তখন দুঃশাসনের পুত্র তাকে হত্যা করলো। অভিমন্যু অসংখ্য হাতি, ঘোড়া ও রথ ধ্বংস কোরে এবং বহু বীর ও রাজা বৃহদ্বলকে বধ কোরে মৃত্যুবরণ করেছে।

অর্জুন ‘হা পুত্র’ বলে পড়ে গেলেন, তার পর চেতনা লাভ করে ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, আমি প্রতিজ্ঞা করছি, জয়দ্রথ যদি ভয় পেয়ে দুর্যোধনাদিকে ত্যাগ কোরে না পালায় তবে আগামীকালই তাকে বধ করবো। সে যদি আমার বা কৃষ্ণের বা মহারাজ যুধিষ্ঠিরের শরণাপন্ন না হয়, তবে কালই তাকে বধ করবো। যদি কাল তাকে নিহত করতে না পারি তবে যে নরকে মাতৃহন্তা ও পিতৃহন্তা যায়, বিশ্বাসঘাতক, গোহত্যাকারী এবং ব্রাহ্মণহত্যাকারী যায়, সেই নরকে আমি যাবো। যে ব্যক্তি পা দিয়ে ব্রাহ্মণ গরু বা আগুন স্পর্শ করে, নগ্ন হয়ে স্নান করে, অতিথিকে আহার দেয় না, উৎকোচ নেয়, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, স্ত্রী পুত্র ভৃত্য ও অতিথিকে ভাগ না দিয়ে মিষ্টান্ন খায়, যে কৃতঘ্ন এবং ধর্মচ্যুত সেই ব্যক্তি যে নরকে যায় সেই নরকে আমি যাবো। আরও প্রতিজ্ঞা করছি শুনুন - পাপী জয়দ্রথ জীবিত থাকতে যদি কাল সূর্যাস্ত হয় তবে আমি জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করবো। সুরাসুর, ব্রহ্মর্ষি, দেবর্ষি, স্থাবর, জঙ্গম কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না, সে রসাতলে, আকাশে, দেবপুরে বা দানবপুরে যেখানেই যাক, আমি শরাঘাতে তার শিরচ্ছেদ করবো। এই বলে অর্জুন গাণ্ডীব ধনুর জ্যা আকর্ষণ করলে তার আওয়াজ আকাশ স্পর্শ করলো। তার পর কৃষ্ণ পাঞ্চজন্য এবং অর্জুন দেবদত্ত শঙ্খ বাজালে আকাশ পাতাল ও পৃথিবী কেঁপে উঠল।

______________

(ক্রমশ)