দিনটা ছিল যুদ্ধের একাদশ দিন, সেদিন ভোরের হিমে ঢাকা ছিল কার্গিল সীমান্ত। তিনটি সেনা বাহিনীর জিপ এগিয়ে চলছিল ধীরে ধীরে, ঘন কালো মেঘ আর রুক্ষ মাটির মাঝ দিয়ে। পাহাড় যেনো নেমে এসেছিল সড়কের মুখে মুখে, বিশাল, শান্ত আর শীতল। চারদিকে ছিলো শূন্যতা, তবুও সকলের নিঃশ্বাসে টান ছিল এক অজানা আশঙ্কার।
জিপের সামনে বসে ছিল সেই মিশনের কমান্ডার অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়। মুখে নীরবতা, চোখে শীতল হিসেব। যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতির কথা ভাবছিল সে।
পাশের গাড়িতে ছিল ক্যাপ্টেন অর্জুন সিংহ, অনির্বাণের সবচেয়ে পুরনো আর খুব কাছের বন্ধু, যে এনডিএর প্রথম দিন থেকে তার সাথে ছিল। দুজনেই একে অপরকে চিনত চোখের ভাষায়—কিছু না বলেই বুঝে যেত কার কখন ঠিক কোথায় কভার ফায়ার প্রয়োজন, কোন পয়েন্ট থাকে অব্যর্থ গুলি ছুড়বে আরেকজন অথবা কখন কে আঘাত লুকিয়ে লড়ে চলছে—সবকিছু।
যদিও তাদের বন্ধুত্বটা শুরু হয়েছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে দিয়ে।
একদিন অনির্বাণকে একটা ডেমো হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাট ক্লাসে হারিয়েছিল অর্জুন। আর সেটা অনির্বাণ কিছুতেই মানতে পারেনি। ছোটো থেকে karate, judo তে প্রশিক্ষণ পাওয়া অনির্বাণের আত্মসম্মানে লেগেছিল সেই পরাজয়।
তারপর প্রতিটা ক্লাসই ছিলো ওদের দুজনের কাছে একটা নীরব যুদ্ধ। কে বেশি অব্যর্থ গুলি টার্গেটে লাগবে। কে সব থেকে দ্রুত হার্ডল রেস শেষ করবে। এমনকি কে তাড়াতাড়ি খাবার খাওয়া শেষ করবে সেটাও ছিলো তাদের প্রতিযোগিতার বিষয়।
অথচ এই প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠেছিল এক গভীর বন্ধুত্ব। NDA এর দ্বিতীয় বছর যখন তারা রুমমেট হয় তার পর আর তাদের আলাদা দেখাই যেত না কখনো ক্যাম্পাসে।
এর পর কত গুলো পোস্টিং, মিশন সব একসাথে তারা সফলভাবে নিষ্পত্তি করেছে তার হিসেব নেই। সেদিনটাও ছিলো এরকমই আরেকটা দিন, আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ মিশন।
“পয়েন্ট X থেকে তিন কিলোমিটার দূরে,” ওয়াকিটকিতে কিছু বলছিল অর্জুন।
তারপরই আচমকা একটা ভয়ানক শব্দ—বড্ড ছোট একটা ক্লিক। আর মুহূর্তের মধ্যে চারপাশ ছিঁড়ে বেরিয়ে এল আগুনের স্ফুলিঙ্গের সাথে ঘন কালো ধোঁয়ার আস্তরণ। জিপগুলো উল্টে গেল, বিস্ফোরণের তাপে পাহারও কেঁপে উঠল। অনির্বাণ ছিটকে পড়ল পাহাড়ের এক ঢালে, তার মাথায় রক্ত, কাঁধে ধাতব টুকরো। কিন্তু তখনো তার চোখ খোলা ছিল, আর সেই চোখে যা দেখল, তা সারাজীবন সে ভুলতে পারবে না।
অর্জুন মাটিতে পড়ে ছিল। শরীরের অর্ধেক ছিন্ন, বাঁ হাতটা কাঁধ থেকে আলাদা হয়ে একটু দূরে পরে আছে, চারিদিকে রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে, একটা চোখ আর নেই, মুখে লেগে আছে একটা নিঃশব্দ আর্তনাদ।
অনির্বাণ হামাগুড়ি দিয়ে কাছে যেতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু রক্তে ভেজা পাথরের উপর তার হাত পিছলে যাচ্ছিল।
“অর্জুন…”
অর্জুনের ঠোঁট নড়েছিল তবে কোনো শব্দ হয়নি। কণ্ঠ যেন আরেকটা বিস্ফোরণের নিচে কোথাও চাপা পড়ে গেছিলো তার।
“তুই… ঠিক আছিস….” অনির্বাণ এই প্রশ্নের উত্তর জানত। তবু অস্ফুটে শব্দ গুলো বেরিয়ে এসেছিল তার ঠোঁট থেকে।
তারপর সে আর কিছু বলেনি। শুধু দেখেছিল কিভাবে অর্জুনের অবশিষ্ট চোখটা ঘোলাটে হয়ে স্থির হয়ে গিয়েছিল শূন্যের দিকে তাকিয়ে।
এর পরেই অচেতন হয়ে গিয়েছিল অনির্বাণ, তাকে টেনে তুলে এনেছিল উদ্ধারকারী দল। তার দিন কেটেছিল পাহাড়ের ধারে সেই জিপের পোড়া গন্ধে, আর রাতগুলিতে শুধু চিৎকার শুনেছিল নিজের ঘুমের মধ্যে।
হাসপাতালে যখন চোখ খুলেছিল অনির্বাণের তখনও তার চারপাশ ঝাপসা, কাঁধে ব্যান্ডেজ, সারা শরীরে ছিল অসহ্য যন্ত্রণা, কিন্তু তার চেয়েও বেশি অসহনীয় ছিল—ভেতরে আর্তনাদ।
ঘরে প্রথম ঢুকেছিল একজন নারী সেনা চিকিৎসক। চোখে পেশাদার স্থিরতা, মুখে কোনো বাড়তি ভণিতা নেই।
“আমি ক্যাপ্টেন রূপসা সেন। আপনার ট্রমা কেস আমি হ্যান্ডল করছি,” বলেছিল সে।
অনির্বাণ কিছু বলেনি প্রথম দিন। শুধু তাকিয়ে ছিল।
প্রতিদিন সে আসত। ওষুধ দিত, ইনজেকশন দিত, রিপোর্ট পড়ত। কোনো দিন গল্প করত না, শুধু পাশে বসে থাকত অনেকটা সময়।
কয়েকদিন পর একদিন অনির্বাণ বলেছিল, “আপনি সবসময় চুপ করে থাকেন কেন? কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন।”
রূপসা একটু ভেবে বলেছিল, “কারণ আমি জানি এখন আপনার এখন প্রশ্নের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন আছে কেউ আপনার পাশে আছে সেটা জানার।”
তারপর একদিন, অনির্বাণ জানতে পারে, তার বাবাও মারা গেছেন— যখন সে যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে ছিল অচেতন হয়ে। সে ফিরতে পারেনি নিজের বাবার দাহে। সেই ব্যথা কোনো অস্ত্রোপচারের টেবিলে ধরা পড়ে না।
সুস্থ হওয়ার পর অনির্বাণ আর সেনাবাহিনীতে ফিরতে চায়নি। সে সেনা বোর্ডে জানিয়েছিল, “আমি আমার সব রেখে এসেছি ওই পাহাড়ে।”
রূপসা তখনও কিছু বলেনি। শুধু একদিন জানলার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “সবাই হয়তো ফিরে আসে না। কিন্ত যারা ফিরে আসে তাদের মনে তারা বেছে থাকবে চিরদিন। সেই জন্যই করো ফিরে আসাটা খুব ভাগ্যের।”
সেই সময়টায় রূপসা ছিল একমাত্র মানুষ, যার পাশে বসে অনির্বাণ ভেঙে পড়তে ভয় পায়নি। তার অন্ধকার জীবনে প্রদীপের মত আলো জ্বালিয়েছিল রূপসা।
কালের নিয়মে দিন কেটে গিয়েছে, অনেকগুলো বছরও কোথায় মিলিয়ে গেছে। জীবনের মোড় ঘুরেছে। অনির্বাণ সেনা ছেড়ে দিয়েছে, অন্য এক জীবন বেছে নিয়েছে। যে আগুনে সে তার সম্পূর্ণ টিমকে জ্বলে যেতে দেখেছে সেই আগুনের মধ্য দিয়েই আবার জন্ম নিয়েছে—দমকলবাহিনীতে কাজ শুরু করেছে, জীবন বাঁচানোর জন্য, মৃত্যুর মুখ থেকে মানুষকে টেনে তোলার জন্য নিজের সর্বস্ব উৎসর্গ করেছে।
কিন্তু রাতগুলো তবু তার ঠিক আগের মতোই থেকে গেছে।
সেই রাতেও তার ঘুম ভেঙে উঠেছিল হঠাৎ। বুক ধড়ফড় করছিল, কপাল ঘামে ভিজে। হাত দিয়ে মুখ চেপে সে বসে ছিল বিছানায়।
রূপসা দরজা খুলে ঘরে ঢুকেছিল। গায়ে নীল শাল, চোখে আধো ঘুম। তার মনে হয় ভোরবেলার শিফট এ হাসপাতাল যেতে হবে তাই তৈরি হচ্ছিল বাইরের ঘরে। অনির্বাণের চিৎকার শুনে ছুটে এসেছে।
“আবার সেই স্বপ্নটা?” ধীরে ধীরে অনির্বাণের পাশে এসে বসেছিল রূপসা।
অনির্বাণ মাথা নিচু করে বলেছিল, “সবাই চলে গেল। আমার সামনে… আবার। অর্জুন… আমার পুরো টিম….।
আমি কেন বেঁচে আছি, রূপসা? আমি যে অভিশপ্ত, জন্মেই মাকে মেরেছি তারপর অর্জুন, বাবা, যে আমাকে ভালোবেসেছে তারই যে ক্ষতি হয়েছে….”
অনির্বাণের কণ্ঠ কাঁপছিল।
অনির্বাণের এই কথাগুলো রূপসা আগেও অনেকবার শুনেছে, যখনই তারা মা বাবা হওয়ার কথা ভেবেছে অনির্বাণের এই ভয় তাদের এগোতে দেয়নি। কখনও কখনও বড্ড ভয় হয় রূপসার। সেই যুদ্ধের ক্ষত থেকে যে অনির্বাণ আজও সেরে ওঠেনি। আজও যে সে বিশ্বাস করে যে তার জীবনের মূল্য অন্যদের থেকে কম, সেদিন বেঁচে ফিরে আসার কোনো অধিকার তার ছিল না। কিন্তু অর্ধেক যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে যাওয়া এই মানুষটাকে যে বড়ই ভালোবাসে রূপসা।
অনির্বাণের পিঠে আলতো হাত রাখে সে, “মনে আছে তো কি কথা দিয়েছিলে আমায় বিয়ের আগে?” মৃদু কন্ঠে বলে ওঠে রূপসা।
অনির্বাণ চোখ বন্ধ করে তার কাঁধে মাথা রাখে।
“তুমি তো জানো, আমি এখনো সেই পাহাড়ের নিচে আটকে আছি।”
রূপসা ধীরে ধীরে বলে, “আমিও তো তোমার পাশেই আছি। একদিন ঠিকই তোমাকে টেনে বের করবো ওই পাহাড়ের নিচ থেকে। ”
ঘর আবার নীরব হয়ে যায়। বাইরে দূরে শোনা যায় কোনো গাড়ির শব্দ, আর ভেতরে শুধুই তাদের ক্লান্ত নিঃশ্বাস।
অনির্বাণ জানে, যুদ্ধ শেষ হয় না। কিন্তু সে যে কথা দিয়েছিল রূপসাকে একদিন সে ঠিক ফিরবে, সম্পূর্ণ হয়ে ফিরবে রূপসার কাছে। সেই দিনটির জন্যই হয়তো তাকে সারাজীবন লড়ে যেতে হবে।
চলবে....
এই পর্বে দেখলেন অনির্বাণের অতীত, আর তার স্ত্রীর পরিচয়।
পরের পর্বে আমরা ফিরে যাবো আগুন থেকে উদ্ধার করা সেই শিশুদুটির কাছে। দেখবো তাদের সাথে অনির্বাণ আর রূপসার কি সম্পর্ক গড়ে উঠছে।
পাঠক বন্ধুদের অনুরোধ এই পর্বটি কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবেন।
ধন্যবাদ।