The Curse of Matangi - 1 in English Spiritual Stories by MOU DUTTA books and stories PDF | মাতঙ্গীর অভিশাপ - 1

Featured Books
Categories
Share

মাতঙ্গীর অভিশাপ - 1

অভিশাপের বীজ

গঙ্গার স্বচ্ছ নীল জলে ভোরের আলো ঝিকমিক করছে। তার ওপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মহীরুহের মতো এক পাহাড়, আর তার কোলে বিস্তৃত ছোট্ট রাজ্য গিরিরামপুর। পাহাড়ের বুক ঘেঁষে, গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা রাজপ্রাসাদটিকে দেখে মনে হতো যেন দেবতাদের বাসস্থান। রাজ্য ছোট হলেও তার শৃঙ্খলা, শান্তি আর প্রজাদের সুখে দেশজুড়ে সুনাম ছড়িয়ে ছিল।

রাজা বীরেন্দ্রনাথ সিংহ ছিলেন ন্যায়পরায়ণ, প্রজাহিতৈষী আর গভীরভাবে ধর্মবিশ্বাসী মানুষ। প্রতিদিন ভোরে গঙ্গাজল নিয়ে পূজা করতেন, মন্দিরে গিয়ে দেবীকে প্রণাম না করে তিনি কখনো দিনের কাজ শুরু করতেন না। রানী সুবর্ণপ্রভা ছিলেন শান্ত, মধুরকণ্ঠী নারী—যিনি প্রাসাদের ভেতরে যেন এক আলোর প্রদীপের মতো ছড়িয়ে দিতেন মমতা।

কিন্তু তাঁদের একমাত্র পুত্র রাজপুত্র অদিত্যের চরিত্রে ছিল ভিন্নতা। অদিত্য সুদর্শন, শক্তিশালী, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হলেও অন্তরে অহঙ্কার আর অবহেলা ভর করেছিল। ছোট থেকে রাজস্নেহে বড় হওয়ায়, সে ভাবত পৃথিবীর সবকিছুই তার অধীন। রাজার ধৈর্য, রানীর মমতা, সভাসদদের প্রশংসা—এসব তাকে আরও উদ্ধত করে তুলেছিল।

রাজসভায় অনেকেই মুখে রাজপুত্রের প্রশংসা করলেও অন্তরে তাকে ঘৃণা করত। বিশেষ করে মন্ত্রী রঘুনাথ সেন আর রাজপরিবারের এক আত্মীয় দামোদর সিংহ—এরা বাইরে থেকে অদিত্যের ভক্ত সেজে থাকলেও গোপনে রাজপুত্রের সর্বনাশের পরিকল্পনা করত। তাঁরা জানত, একদিন এই রাজপুত্রই সিংহাসনে বসবে, আর তখন রাজ্যের সর্বনাশ অনিবার্য। তাই বাইরে থেকে মধুর বাক্যে তাকে ভুল পথে চালিত করাই তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল।

অদিত্যর এক বড় সমস্যা ছিল তার খামখেয়ালি স্বভাব। ছোট ভুলে সে বড় সিদ্ধান্ত নিত, কারও উপদেশ শুনতে চাইত না। প্রাসাদের ভেতরে দাস-দাসী, সৈন্যদের ওপর রাগ দেখানো, শিকার করতে গিয়ে অহেতুক পশুহত্যা করা—এসব যেন তার নিত্য অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।

একদিন সন্ধ্যায়, রাজা-রানী প্রাসাদে পূজার আয়োজন করলেন। মন্দিরে দেবী মাতঙ্গীর অর্চনা হচ্ছিল। রাজার পূর্বপুরুষরা বিশ্বাস করতেন, মা মাতঙ্গী তাঁদের রাজ্যের রক্ষাকর্ত্রী। তাই প্রতি পূর্ণিমায় বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হত। সেই দিনও পূজা চলছিল, প্রজারা ভক্তি নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল।

কিন্তু রাজপুত্র অদিত্য একেবারেই বিরক্ত। সে মন্দিরে এসে দাঁড়িয়ে মন্ত্রপাঠ শুনে হেসে ফেলল। উচ্চস্বরে বলল—
“এইসব পুরনো নিয়ম-কানুন দিয়ে কী হবে? যুদ্ধাস্ত্র, সেনাবাহিনী—এইগুলোই রাজ্য রক্ষা করে। কোনো দেবী এসে আমাদের শত্রুর হাত থেকে বাঁচাবে না।”

তার এই কথা শুনে রাজা বিস্মিত হলেন, রানী কেঁদে ফেললেন। সভাসদদের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। কিন্তু মন্ত্রী রঘুনাথ সঙ্গে সঙ্গে বলল—
“মহারাজ, রাজপুত্র যা বলেছেন তা ভুল নয়। আজকের যুগে অস্ত্রশক্তিই মূল ভরসা।”
দামোদর সিংহও যোগ করল—
“হ্যাঁ, তবে পূজা তো চলুক। রাজপুত্র যুবক, তিনি যেমন খুশি ভাব প্রকাশ করতে পারেন।”

তাদের কথায় রাজপুত্র আরও উদ্ধত হয়ে উঠল। সে মন্দিরের প্রদীপ উল্টে দিল, আর দেবীর আসনে রাখা মালা মাটিতে ফেলে দিল। প্রজারা হতভম্ব, সবাই নিস্তব্ধ।

ঠিক সেই মুহূর্তে, যেন মন্দির কেঁপে উঠল। প্রদীপের শিখা অদ্ভুতভাবে লম্বা হয়ে গেল, বাতাস থেমে গেল। এক অচেনা সুর বেজে উঠল, আর মন্দিরের ভেতর এক সবুজাভ আলোর ছটা দেখা দিল।

সেই আলোর ভেতর থেকে ভেসে এল এক কণ্ঠ—
“অহঙ্কারই মানুষের পতনের মূল। তুমি যাকে তুচ্ছ করলে, তার আশীর্বাদ ছাড়া কোনো রাজ্য টিকে না। অদিত্য, তোমার রক্তে অভিশাপ নামবে। তোমার সংসারে, তোমার প্রজাদের জীবনে বিপর্যয় আসবে। কেবল ভক্তি আর আরাধনাই মুক্তির পথ।”

সবাই কাঁপতে কাঁপতে নতজানু হয়ে গেল। কণ্ঠ মিলিয়ে যেতেই আলো নিভে গেল, মন্দির আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। কিন্তু রাজ্যের ওপর যেন এক ভয়ঙ্কর ছায়া নেমে এল।

রাজা কেঁদে বললেন—
“হে দেবী, আমার সন্তানের অপরাধ ক্ষমা করো।”

কিন্তু তখন আর কোনো উত্তর আসেনি। কেবল গঙ্গার ঢেউ তীব্র শব্দে আছড়ে পড়ছিল, যেন সেই রোষের সাক্ষী হয়ে।

অদিত্য প্রথমে কিছুক্ষণ চুপ থাকলেও পরে হেসে বলল—
“এ সবই কাকতালীয় ব্যাপার। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”

কিন্তু তার চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা দেখা গেল, যেন দেবীর কণ্ঠস্বর তার অন্তরে কোথাও গভীরভাবে গেঁথে গেছে।

রঘুনাথ আর দামোদর বাইরে থেকে সান্ত্বনার ভান করে বলল—
“রাজপুত্র, ভয় পাবেন না। আপনি তো ভবিষ্যতের অধিপতি। এসব দেবদেবীর কথায় কান দেওয়ার দরকার নেই।”

কিন্তু ভিতরে ভিতরে তারা দুজনেই আনন্দে আত্মহারা। কারণ তারা জানত, আজ থেকেই রাজবংশের পতনের বীজ বপন হয়ে গেছে।

সেই রাতেই রানী সুবর্ণপ্রভা স্বপ্নে দেখলেন—
মা মাতঙ্গী তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। সবুজাভ শরীর, হাতে বীণা, চোখে করুণা আর ভীষণতার মিলন। তিনি বললেন—
“রানী, তোমার ছেলে অহঙ্কারে ভেসে গেছে। এই অভিশাপ শুধু ভক্তির আগুনেই পুড়ে যাবে। ভবিষ্যতে এক নারী আসবে, যিনি তাঁর ভক্তি দিয়ে এই সংসার ও রাজ্যকে রক্ষা করবে।”

রানী ঘুম ভেঙে হাপাতে হাপাতে জেগে উঠলেন। তাঁর চোখে জল, মনে অদ্ভুত আতঙ্ক। তিনি জানলেন—এই ভবিষ্যদ্বাণী একদিন সত্যি হবেই।

রাজা-রানী দুজনেই গোপনে দেবীর কাছে ক্ষমা চাইতে লাগলেন। কিন্তু প্রাসাদের ভেতরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল এক অজানা অশান্তি। সৈন্যরা অকারণে ঝগড়া করতে লাগল, দাসীরা ভয়ে কাজ ফেলে পালিয়ে যেতে লাগল, আর রাজপুত্র অদিত্যের মুখে দিনে দিনে বাড়তে লাগল এক অদ্ভুত ক্রোধ।

রাজ্যের প্রজারা ফিসফিস করে বলতে লাগল—
“দেবী রেগে গেছেন।”

কিন্তু রাজপুত্র তখনও বুঝতে চাইল না। সে মনে করল—সবই তার শত্রুদের ছড়ানো গুজব।

কেবল রানীর হৃদয় জানত—অভিশাপের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। আর একদিন সেই অভিশাপ তাদের বংশধরের সংসারে আগুন ধরাবে।


---
Next part is coming.....

গল্পের শেষ পর্যন্ত সঙ্গে থাকার জন্য সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। 💌 লিখতে গিয়ে কোথাও ভুল হলে তা ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আপনাদের প্রতিটি মন্তব্য আমার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান, কারণ পাঠকের প্রতিক্রিয়াই লেখকের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। আপনারা কীভাবে গল্পটা অনুভব করলেন, কোন অংশ ভালো লেগেছে বা কোথায় আরও ভালো করা যেত—সবটাই জানালে আমার পরবর্তী লেখাগুলোতে নতুন রঙ যোগ হবে। আপনাদের ভালোবাসা আর মতামতই আমার কলমের জ্বালানি। তাই দয়া করে মন্তব্য করতে ভুলবেন না।