মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৪৪
মগধরাজ দণ্ডধার ও পাণ্ড্যরাজ বধ, দুঃশাসনের পরাজয় এবং কর্ণের হাতে নকুলের পরাজয়
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
মগধরাজ দণ্ডধার ও পাণ্ড্যরাজ বধ, দুঃশাসনের পরাজয় এবং কর্ণের হাতে নকুলের পরাজয়
ষোড়শ দিনের যুদ্ধে মগধরাজ দণ্ডধার পাণ্ডবসেনার উত্তরদিকে রথ, হাতি, ঘোড়া ও পদাতিক সেনা বিনষ্ট করছিলেন। সেনাদের আর্তনাদ শুনে কৃষ্ণ রথ ফিরিয়ে নিয়ে অর্জুনকে বললেন, রাজা দণ্ডধার অস্ত্রবিদ্যায় ও পরাক্রমে ভগদত্তের সমান, তার হাতিও বিপক্ষের সেনা বিনষ্ট করে। অতএব তুমি আগে তাকে বধ কোরে তার পর সংশপ্তকদের সঙ্গে যুদ্ধ করো। এই বলে কৃষ্ণ অর্জুনের রথ দণ্ডধারের কাছে নিয়ে গেলেন। দণ্ডধার তখন বাণের আঘাতে পাণ্ডবসৈন্য সংহার করছিলেন, তার হাতিও পা ও শুঁড়ের আঘাতে রথ, ঘোড়া, হাতি ও সৈন্য দলন করছিল। অর্জুন ক্ষুরধার তিন বাণে দণ্ডধারের বাহু ও মাথা ছেদন করলেন এবং হাতি ও মাহুতদেরকে বিনষ্ট করলেন। মগধরাজকে নিহত দেখে তার ভাই দণ্ড হাতির পিঠে এসে কৃষ্ণ ও অর্জুনকে আক্রমণ করলেন, কিন্তু তিনিও অর্জুনের অর্ধচন্দ্র বাণে ছিন্নবাহু ছিন্নমুণ্ড হলেন। তার পর অর্জুন ফিরে গিয়ে আবার সংশপ্তকদের বধ করতে লাগলেন। কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, তুমি খেলা করছ কেন, সংশপ্তকদের দ্রুত বিনষ্ট কোরে কর্ণকে বধ করার জন্য সচেষ্ট হও।
কৃষ্ণের কথায় অর্জুন অবশিষ্ট সংশপ্তকগণকে বধ করলেন। তার পর কৃষ্ণ রথ চালনা কোরে শত্রুসৈন্যদের মধ্যে প্রবেশ করলেন। যুদ্ধভূমি দেখতে দেখতে কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, দুর্যোধনের জন্যই পৃথিবীর রাজাদের এই ভীষণ বিনাশ হচ্ছে। দেখো, চারদিকে ধনুর্বাণ সহ বিভিন্ন অস্ত্র ছড়িয়ে রয়েছে, অস্ত্রধারী যোদ্ধারা প্রাণহীন হয়ে পড়ে আছে। বীরগণের রক্তে রণভূমি কর্দমাক্ত হয়েছে, চারিদিকে আহত জীবিত মানুষ আর্তনাদ করছে। আত্মীয়রা অস্ত্র ত্যাগ কোরে ক্রন্দনরত হয়ে আহতদের পরিচর্যা করছে। অর্জুন, তুমি এই মহাযুদ্ধে যে ভাবে লড়াই করেছ তা তোমার অথবা দেবরাজের পক্ষেই সম্ভব।
বীরশ্রেষ্ঠ বিখ্যাত পাণ্ড্যরাজ পাণ্ডবপক্ষে যুদ্ধ করছিলেন। ইনি নিজেকে ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, অর্জুন, কৃষ্ণ প্রভৃতি মহারথগণের চেয়েও শ্রেষ্ঠ মনে করতেন, ভীষ্ম ও দ্রোণের সঙ্গে নিজের তুলনাও সইতে পারতেন না। এই মহাধনবান সমস্ত প্রকার অস্ত্রে বিশারদ পাণ্ড্য যমরাজের মতো কর্ণের সৈন্য বধ করছিলেন। অশ্বত্থামা তার কাছে গিয়ে মিষ্টবাক্যে যুদ্ধে আহ্বান করলেন। দুজনে তুমুল যুদ্ধ হোলো। অশ্বত্থামা মূহুর্তের মধ্যে অসংখ্য অস্ত্র নিক্ষেপ করলে বায়ব্য অস্ত্রে সেগুলি ব্যর্থ কোরে পাণ্ড্যরাজ আনন্দে গর্জন করতে লাগলেন। অশ্বত্থামা পাণ্ড্যের রথ, ঘোড়া, সারথি এবং সমস্ত অস্ত্র বিনষ্ট করলেন কিন্তু শত্রুকে কাছে পেয়েও বধ করলেন না। এই সময়ে একটি চালকহীন সুসজ্জিত বলশালী হাতি সবেগে পাণ্ড্যরাজের কাছে এসে পড়লে, গজযুদ্ধে কুশল পাণ্ড্য সেই হাতির পিঠে চড়ে বসলেন এবং সিংহনাদ করে অশ্বত্থামার প্রতি একটি তোমর নিক্ষেপ করলেন। তোমরের আঘাতে অশ্বত্থামার মুকুট টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়ল। তখন অশ্বত্থামা আহত সাপের মতো ক্রুদ্ধ হয়ে বাণের আঘাতে হাতির পা, শুঁড় এবং পাণ্ড্যরাজের মাথা কেটে ফেললেন আর পাণ্ড্যের ছয় অনুচরকেও বধ করলেন।
পাণ্ড্যরাজ নিহত হলে কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, আমি যুধিষ্ঠির ও অন্যান্য পাণ্ডবদের দেখছি না, ওদিকে কর্ণ জ্বলন্ত আগুনের মতো যুদ্ধে উপস্থিত হয়েছেন, অশ্বত্থামাও সৃঞ্জয়গণকে বধ করছেন এবং আমাদের হাতি, ঘোড়া, রথী ও পদাতিক সেনা বিনাশ করছেন। অর্জুন কৃষ্ণকে দ্রুত রথ চালাতে বললেন।
কৌরব ও পাণ্ডবগণ যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। প্রাচ্য, দাক্ষিণাত্য, অঙ্গ, বঙ্গ, পুণ্ড্র, মগধ, তাম্রলিপ্ত, মেকল, কোশল, মদ্র, দশার্ণ, নিষধ ও কলিঙ্গ দেশের গজযুদ্ধে বিশারদ যোদ্ধারা পাঞ্চালসৈন্যের উপর বাণ বর্ষণ করতে লাগলেন। সাত্যকি নারাচের আঘাতে বঙ্গরাজকে বধ কোরে হাতির পিঠ থেকে ভূপাতিত করলেন। নকুল অর্ধচন্দ্র বাণে অঙ্গরাজপুত্রের মাথা কেটে ফেললেন। পাণ্ডবগণের বাণবর্ষণে বিপক্ষের বহু হাতি নিহত হোলো। সহদেবের বাণের আঘাতে দুঃশাসন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলে তাঁর সারথি অত্যন্ত ভীত হয়ে রথ নিয়ে পালিয়ে গেল।
নকুল কৌরবসেনা বিনাশ করছেন দেখে কর্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে বাধা দিতে এলেন। নকুল তাকে বললেন, বহুদিন পরে দেবতারা আমার উপর সদয় হয়েছেন, তুমি আমার সামনে এসেছ। পাপী, তুমিই সমস্ত অনর্থ, শত্রুতা ও বিবাদের মূল, আজ তোমাকে বধ কোরে প্রতিশোধ নেব। কর্ণ বললেন, ওহে বীর, আগে তোমার পৌরুষ দেখাও তার পর গর্ব করো। বৎস, প্রকৃত বীরগণ কথা না বলে যথাশক্তি যুদ্ধ করেন, তুমিও তাই করো, আমি তোমার দর্প চূর্ণ করবো। তারপর নকুল ও কর্ণ পরস্পরের প্রতি প্রচণ্ড বাণবর্ষণ করতে লাগলেন। দুই পক্ষের সৈন্য বাণের আঘাতে নিপীড়িত হয়ে দূরে সরে গিয়ে দর্শকের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। কর্ণের বাণে সমস্ত আকাশ মেঘে ঢেকে যাওয়ার মতো ছায়াময় হোলো। কর্ণ নকুলের চার ঘোড়া, রথ, পতাকা, গদা, খড়্গ, চর্ম প্রভৃতি বিনষ্ট করলেন, নকুল রথ থেকে নেমে একটা পরিঘ নিয়ে দাঁড়ালেন। কর্ণের বাণের আঘাতে সেই পরিঘও নষ্ট হোলো, তখন নকুল দ্রুত পালাতে লাগলেন। কর্ণ দ্রুতবেগে গিয়ে তার বৃহৎ ধনু নকুলের গলায় লাগিয়ে সহাস্যে বললেন, তুমি যে মিথ্যা বাক্য বলেছিলে, এখন বার বার আহত হবার পর আবার তা বল দেখি। তুমি বলবান কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধ কোরো না, নিজের সমান যোদ্ধাদের সঙ্গেই যুদ্ধ করো। আমার কাছে পরাজয়ের জন্য লজ্জিত হয়ো না। এখন ঘরে ফিরে যাও অথবা কৃষ্ণ ও অর্জুনের কাছে যাও। বীর ও ধর্মজ্ঞ কর্ণ নকুলকে বধ করতে পারতেন, কিন্তু কুন্তীর অনুরোধ স্মরণ করে মুক্তি দিলেন। মনের দুঃখে নকুল অবরুদ্ধ সাপের মতো নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়ে তাঁর রথে উঠলেন। কর্ণ তখন পাঞ্চালসৈন্যদের দিকে গেলেন। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর বহু পাঞ্চালসৈন্য বিধ্বস্ত হোলে বাকি পাঞ্চালবীরগণ বেগে পালাতে লাগলেন, কর্ণও তাদের পিছনে ধাবিত হলেন।
দুর্যোধনের বৈমাত্রেয় ভাই যুযুৎসু পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি দুর্যোধনের বিশাল বাহিনী নিপীড়িত করছেন দেখে শকুনিপুত্র উলূক তাকে আক্রমণ করলেন। যুযুৎসুর ঘোড়া ও সারথি বিনষ্ট হোলো, তিনি অন্য রথে উঠলেন। বিজয়ী উলূক তখন পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়দের সাথে যুদ্ধ করতে গেলেন।
দুর্যোধনের ভাই শ্রুতকর্মা নকুলপুত্র শতানীকের ঘোড়া রথ ও সারথি বিনষ্ট করলে শতানীক ভাঙ্গা রথে থেকেই একটি গদা নিক্ষেপ করলে তার আঘাতে শ্রুতকর্মার ঘোড়া রথ ও সারথি বিনষ্ট হোলো। তখন রথহীন দুই বীর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রণভূমি থেকে চলে গেলেন।
ভীমের পুত্র সুতসোম শকুনির সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন। শকুনির বাণের আঘাতে সুতসোমের ঘোড়া রথ ও ধনু প্রভৃতি নষ্ট হোলে, সুতসোম ভূমিতে নেমে বিশাল খড়্গ ঘোরাতে লাগলেন। শকুনি তীক্ষ্ম ক্ষুরপ্রের আঘাতে সুতসোমের খড়্গ দ্বিখণ্ড করলে সুতসোম তার হাতে থাকা খড়্গের অংশ নিক্ষেপ করে শকুনির ধনু ভেঙ্গে ফেললেন। তার পর শকুনি অন্য ধনু নিয়ে পাণ্ডবসৈন্যের দিকে ধাবিত হলেন।
কৃপাচার্যের সঙ্গে ধৃষ্টদ্যুম্নের যুদ্ধ হচ্ছিল। কৃপের বাণের আঘাতে আহত ও অবসন্ন হয়ে ধৃষ্টদ্যুম্ন ভীমের কাছে চলে গেলে কৃপ শিখণ্ডীকে আক্রমণ করলেন। বহুক্ষণ যুদ্ধের পর শিখণ্ডী মূৰ্ছিত হলে তাঁর সারথি রণভূমি থেকে সত্বর রথ সরিয়ে নিয়ে গেল।
______________
(ক্রমশ)