কিছু বছর পূর্বের ঘটনা। অনেকেই জানেন,- আবার বলছি।   
এক উচ্চশিক্ষিত দম্পতি। স্বামী-স্ত্রী দু'জনেই কোন একটা কলেজে পড়ান। জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে গেছেন। ছেলে-মেয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। 
  তারা দু'জনেই এক শীতের সকালে পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীআচার্য্যদেবের কাছে এসে প্রনাম করে জানালেন,-" আমরা অনেকদিন যাবত নানা সাংসারিক ঝামেলা ও ভুল বুঝাবুঝি নিয়ে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। আর পারছিনা। সিদ্ধান্ত নিয়েছি,- আমরা এইবার আলাদা হব,- ডাইভোর্স নেব। আপনার চরনে আমাদের এই সিদ্ধান্ত নিবেদন করতে এসেছি।"  
শ্রীশ্রীআচার্য্যদেব  তাদের এই নিবেদন শুনে ভীষণ ভারাক্রান্ত হয়ে গেলেন। কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন,-" আপনারা তো সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন,- আমার আর কিছু বলার নেই৷ শুধু একটা অনুরোধ করব,- যদি কথা দেন  আমার সেই অনুরোধ রাখবেন। "  
সেই দম্পতি হাত জোর করে বল্লেন,- " আজ্ঞে, আপনি আদেশ করুন।"  
তখন শ্রীশ্রীআচার্য্যদেব  সেই ভদ্রমহিলার উদ্দেশ্যে বললেন,-" আপনারা তো আলাদা হয়েই যাবেন৷ আমার শুধু একটা ইচ্ছা,-আপনি যদি আপনার গলার মাফলারটা আপনার স্বামীর গলায় জড়িয়ে দিয়ে তাকে একটা প্রনাম করেন,- আমার খুব ভাল লাগবে।"  
সেই আদেশ পেয়ে উচ্চ শিক্ষিতা অধ্যাপিকা মহিলা একটু ইতস্তত করতে লাগলেন। কারন,-উনি উচ্চবিত্ত-উচ্চশিক্ষিতা আধুনিক মহিলা,- স্বামীকে কখনো সাষ্টাঙ্গে প্রনাম করার অভ্যাস নেই। অনভ্যাসের জড়তা ও সংকোচ তাকে ঘিরে ধরল।   কিন্তু কথা দিয়ে ফেলেছেন যে!  তাই অত্যন্ত সংকোচতার সাথে নিজের গলার মাফলারটা খুলে সামনে দাড়ানো স্বামীর গলায় জড়িয়ে দিয়ে তাকে সাষ্টাঙ্গে প্রনাম করলেন।   
আর, প্রনাম করার সাথে সাথেই  তার স্বামী ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন। তার কান্না দেখে প্রনামরতা  স্ত্রীও কাঁদতে লাগলেন। সেখানে উপস্থিত সকলের চোখেই জল ভরে আসল এই দৃশ্য দেখে।   কাঁদতে কাঁদতে স্বামী ব্যাক্তিটি শ্রীশ্রীআচার্য্যদেবকে উদ্দেশ্যে  বলতে লাগলেন,-" দাদা, আমি শুধু এই সামান্য শ্রদ্ধা ও সম্মানটকুই চেয়েছি এতদিন আমার স্ত্রীর কাছে। আমাদের কোন সমস্যা নেই,- কোন অভাব নেই৷ তার চোখে আমার প্রতি কোন শ্রদ্ধা না পেয়ে পেয়ে আমি নিজেকে এই সিদ্ধান্তে দাঁড় করিয়েছি। "  
 সেদিন তারা চলে যান।  পরে জানা যায়,-তারা আর ডিভোর্স নেন নি। নিজেদের ভুল-ত্রুটি শুধরিয়ে একসাথে আবার চলতে লাগলেন।
  শ্রীশ্রীআচার্য্যদেব কোন যাদুমন্ত্র প্রয়োগ করেননি,- কোন অলৌকিক ক্ষমতা দেখাননি। তিনি তাঁর বিচক্ষনতা ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দিয়ে সেই প্রৌঢ় দম্পতির মনোমালিন্যের মূল কারনটা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। এবং সেই দম্পতিকে ছোট্ট একটা আচরনের মধ্য দিয়ে তাদের ভুলটা ধরিয়ে দিয়েছেন।   
আজকাল অনেক উচ্চশিক্ষিত আধুনিক দম্পত্তির মধ্যেই এই পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ না থাকার কারনে সাংসারিক ঝামেলা প্রকট হয়ে উঠছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক হিসাবে নিয়ে কিছুদিন পরই দ্বন্দে লিপ্ত হচ্ছে। পুরুষ স্বভাবতই  স্ত্রীর কাছ থেকে শ্রদ্ধা,সম্মান ও নির্ভরতা আশা করে,- স্ত্রীও তার অবচেতন মনে চায় পুরুষের উপর নিশ্চিন্তে নির্ভরশীল হয়ে সুখে থাকতে। স্বামী-স্ত্রী দুইজন বয়স-যোগ্যতা সবদিক দিয়ে সমান সমান হলে ভাল বন্ধু হিসাবে কিছুদিন হয়ত কাটাতে পারে,- কিন্তু সেই শ্রদ্ধা ও নির্ভরশীলতার অভাবে কিছুদিন পরই সাধারনতঃ   জন্ম নিতে পারে দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধা।  শেষে সম্পর্ককে টেনে নিতে পারে কোর্টের দিকে। 
শাস্ত্রে স্বামী ও পিতাকে একজন নারীর কাছে সমান শ্রদ্ধার পাত্র হিসাবে বর্ননা করা হয়েছে। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর এই শ্রদ্ধা ও সমীহবোধ সংসারে সাম্যাবস্থা বজায় রাখে, স্থায়ীত্ব বৃদ্ধি পায়, একে অপরকে পূরন-পোষনে সহায়ক হয়। শ্রীশ্রীঠাকুর বলেন,- পুরুষ যে বয়সে বায়োলজিকালি পিতা হবার ক্ষমতা অর্জন করে, - স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যদি সেই বয়সের পার্থক্য থাকে তবে স্ত্রীর জীবনীশক্তি স্বামীতে সঞ্চারিত হয়ে উভয়ের মধ্যে সাম্যতা বজায় রাখে। 
আজকাল আধুনিক উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে এবং বলিউডের কুশীলবদের অনুকরন করার দরুন আধুনিক যুবক যুবতীরা বিবাহের ক্ষেত্রে এই বয়সের পার্থক্যটুকু রক্ষা করতে অস্বীকার করে। নানা যুক্তি ও  অজুহাতের অবতারনা করে নিজেদের প্রবৃত্তি পূরনে মরীয়া হয়ে উঠে।
 প্রকৃতির বিধানকে কেউ অস্বীকার করতেই পারে,- তা পালন করতে কেউ কাউকে বাধ্য করবে না। কিন্তু বিধান অগ্রাহ্য করার পরিনতিও কাউকে ছাড়বে না৷ তাই তো এক দশক পূর্বে প্রতি এক হাজার দম্পতির মধ্যে একটি দম্পত্তি ডাইভোর্সের জন্য আদালতে যেত,- বর্তমানে এই সংখ্যাটি এক থেকে তের হয়ে গেছে। দিন দিন এই অশান্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তি তর্ক দিয়ে, নিজ মনমাফিক প্রবৃত্তিপূরনী চলনা দিয়ে এই ধ্বংস আটকানো যাবে না। (.....চলবে)