মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৬০
কৃপাচার্য ও দুর্যোধনের কথোপকথন
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
কৃপাচার্য ও দুর্যোধনের কথোপকথন
কৌরবপক্ষের দুরবস্থা দেখে সৎস্বভাব তেজস্বী বৃদ্ধ কৃপাচার্য দুর্যোধনকে বললেন, মহারাজ, ক্ষত্রিয়ের পক্ষে যুদ্ধধর্মই শ্রেষ্ঠ, পিতা পুত্র ভাই মামা ভাগ্নে আত্মীয় ও বান্ধবের সঙ্গেও ক্ষত্রিয়কে যুদ্ধ করতে হয়। যুদ্ধে মৃত্যুই ক্ষত্রিয়ের পরম ধর্ম এবং পলায়নই অধর্ম। কিন্তু ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ জয়দ্ৰথ, তোমার ভাইয়েরা এবং তোমার পুত্র লক্ষ্মণ, সকলেই মারা গেছেন, আমরা কাকে আশ্রয় করবো? সাধুস্বভাব পাণ্ডবদের প্রতি তোমরা অকারণে অসদ্ব্যবহার করেছ, তারই ফল এখন উপস্থিত পাচ্ছ। বৎস, যুদ্ধে সাহায্যের জন্য তুমি যেসকল যোদ্ধাকে আনিয়েছ তাদের এবং তোমার নিজেরও প্রাণসংশয় হয়েছে, এখন তুমি আত্মরক্ষা করো। বৃহস্পতির নীতি এই - বিপক্ষের চেয়ে দুর্বল হোলে অথবা তার সমকক্ষ হোলে সন্ধি করবে, বলবান হোলে যুদ্ধ করবে। আমরা এখন হীনবল, অতএব পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করাই উচিত। ধৃতরাষ্ট্র ও কৃষ্ণ অনুরোধ করলে দয়ালু যুধিষ্ঠির নিশ্চয় তোমাকে রাজপদ দেবেন, ভীম অর্জুন প্রভৃতিও সম্মত হবেন।
শোকাতুর দুর্যোধন কিছুকাল চিন্তা কোরে বললেন, সুহৃদের যা বলা উচিত আপনি তাই বলেছেন, প্রাণের মায়া ত্যাগ কোরে আপনি পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধও করেছেন। ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ, মুমূর্ষুর যেমন ঔষধে রুচি হয় না তেমন আপনার যুক্তিসম্মত উপদেশ আমার ভালো লাগছে না। আমরা যুধিষ্ঠিরকে রাজ্য থেকে নির্বাসিত করেছিলাম, তার প্রেরিত দূত কৃষ্ণকেও প্রতারিত করেছিলাম। এখন তিনি আমার অনুরোধ শুনবেন কেন? আমরা অভিমন্যুকে বিনাশ করেছি, কৃষ্ণ ও অর্জুন আমাদের হিতাচরণ করবেন কেন? ক্রুদ্ধস্বভাব ভীম উগ্র প্রতিজ্ঞা করেছে, সে মরবে তবু নত হবে না। যমতুল্য নকুল ও সহদেব তরবারি ও ঢাল ধারণ করে আছে। ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডীর সঙ্গেও আমার শত্রুতা আছে। পাশা খেলার সভায় সকলের সামনে যিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন সেই দ্রৌপদী আমার বিনাশ ও স্বামীদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য উগ্র তপস্যা করছেন, তিনি প্রতিদিন মাটিতে শয়ন করেন। কৃষ্ণের বোন সুভদ্রা অভিমান ও দর্প ত্যাগ কোরে সর্বদা দাসীর মতো দ্রৌপদীর সেবা করেন। এইসকল কারণে এবং বিশেষত অভিমন্যুবধের ফলে যে শত্রুতার আগুন প্রজ্বলিত হয়েছে তা নিভে যায়নি, অতএব কি কোরে পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি হবে? পৃথিবীর রাজা হয়ে আমি কি কোরে পাণ্ডবদের দয়ায় রাজ্য ভোগ করবো, দাসের মতো যুধিষ্ঠিরের পিছনে যাবো, আত্মীয়দের সঙ্গে দীনভাবে জীবিকানির্বাহ করবো? এখন ক্লীবের মতো আচরণের সময় নয়, আমাদের যুদ্ধ করাই উচিত। যে বীরগণ আমার জন্য নিহত হয়েছেন তাদের উপকার স্মরণ কোরে এবং তাদের ঋণ শোধের বাসনায় আমার রাজ্যের প্রতিও আর রুচি নেই। পিতামহ ভাই ও বন্ধুদেরকে নিপাতিত কোরে যদি আমি নিজের জীবন রক্ষা করি তবে লোকে নিশ্চয় আমার নিন্দা করবে। আমি যুধিষ্ঠিরকে প্রণিপাত কোরে রাজ্যলাভ করতে চাই না, বরং ন্যায়যুদ্ধে নিহত হয়ে স্বর্গলাভ করবো।
দুর্যোধনের কথা শুনে ক্ষত্রিয়গণ প্রশংসা কোরে সাধু সাধু বলতে লাগলেন এবং পরাজয়ের জন্য শোক না কোরে যুদ্ধ করবার জন্য প্রস্তুত হলেন। তারপর তারা বাহনদের পরিচর্যা কোরে হিমালয়ের নিকটে সমতল প্রদেশে গেলেন এবং অরুণবর্ণ সরস্বতী নদীতে স্নান ও তার জল পান করলেন। সেখানে কিছুকাল থেকে তারা দুর্যোধন কর্তৃক উৎসাহিত হয়ে রাত্রিবাসের জন্য শিবিরে ফিরে এলেন।
______________
(ক্রমশ)