Story of Mahabharat Part 73 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 73

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 73

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৭৩

দেবরাজ ইন্দ্রকে কর্ণের কবচ-কুণ্ডল দানের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

দেবরাজ ইন্দ্রকে কর্ণের কবচ-কুণ্ডল দানের কাহিনি

অনেক আগেই লোমশ মুনি যুধিষ্ঠিরকে জানিয়েছিলেন যে দেবরাজ ইন্দ্র কর্ণের সহজাত কুণ্ডল ও কবচ হরণ করে তাঁর শক্তিক্ষয় করবেন। পাণ্ডবদের বনবাসের প্রায় বারো বছর পার হোলে ইন্দ্র তার প্রতিজ্ঞা পালনে উদ্যোগী হলেন। ইন্দ্রের মতলব জানতে পেরে সূর্য নিদ্রিত কর্ণের নিকট গেলেন এবং স্বপ্নযোগে ব্রাহ্মণের মূর্তিতে দর্শন দিয়ে বললেন, বৎস, পাণ্ডবদের হিতের জন্য ইন্দ্র তোমার কুণ্ডল ও কবচ হরণ করতে চান। তিনি জানেন যে সাধু ব্যক্তি তোমার কাছে কিছু চাইলে তুমি দান করো। তিনি ব্রাহ্মণের বেশে তোমার কবচ ও কুণ্ডল চাইতে তোমার কাছে যাবেন। তুমি দিও না, তাতে তোমার আয়ুক্ষয় হবে।

কর্ণ প্রশ্ন করলেন, আপনি কে? সূর্য বললেন, আমি সূর্য, তোমার পিতা। কর্ণ বললেন, সকলেই আমার এই ব্রত জানে যে প্রার্থী ব্রাহ্মণকে আমি প্রাণও দান করতে পারি। ইন্দ্র যদি পাণ্ডবদের হিতের জন্য ব্রাহ্মণবেশে আমার কবচ ও কুণ্ডল চান তবে আমি অবশ্যই দান করবো, তাতে আমার সুনাম এবং ইন্দ্রের বদনাম হবে।

কর্ণকে বোঝানোর জন্য সূর্য বহু চেষ্টা করলেন, কিন্তু কর্ণ রাজি হলেন না। তিনি বললেন, আপনি উদ্বিগ্ন হবেন না, অর্জুন যতই পরাক্রমশালী হোক না কেন, তাকে আমি যুদ্ধে জয় করব। আপনি তো জানেন যে আমি পরশুরাম ও দ্রোণের নিকট অস্ত্রশিক্ষা লাভ করেছি। সূর্য বললেন, তবে তুমি ইন্দ্রকে এই কথা বলো “আপনি আমাকে শত্রুনাশক অব্যর্থ শক্তি অস্ত্র দিন তবে কবচ ও কুণ্ডল দেবো”। কর্ণ সম্মত হলেন।

প্রত্যেক দিন দুপুরবেলা কর্ণ স্নানের পর জল থেকে উঠে সূর্যের স্তব করতেন, সেই সময়ে ধন প্রাপ্তির আশায় ব্রাহ্মণরা তার কাছে আসতেন এবং কর্ণ তাদের প্রার্থিত ধন দান করতেন। একদিন দেবরাজ ইন্দ্র ব্রাহ্মণের বেশে তার কাছে এসে বললেন, কর্ণ, তুমি যদি সত্যব্রত হও তবে তোমার সহজাত কবচ ও কুণ্ডল শরীর থেকে কেটে আমাকে দান করো। কর্ণ বললেন, ভূমি, স্ত্রী, গরু, বাসস্থান, বিশাল রাজ্য প্রভৃতি যা চান দেবো, কিন্তু আমার সহজাত কবচ ও কুণ্ডল দিতে পারি না, কারণ তাতেই আমি অবধ্য হয়েছি।

ইন্দ্র আর কিছুই নেবেন না শুনে কর্ণ সহাস্যে বললেন, দেবরাজ, আপনাকে আমি পূর্বেই চিনেছি। আমার কাছ থেকে বৃথা দান নেওয়া আপনার যোগ্য নয়। আপনি দেবগণের ও অন্য প্রাণিগণের ঈশ্বর, আপনার উচিত আমাকে বর দেওয়া। ইন্দ্র বললেন, সূর্য পূর্বে জানতে পেরে তোমাকে সতর্ক করে দিয়েছেন। বৎস কর্ণ, আমার বজ্র ভিন্ন যা ইচ্ছা করো তা তুমি নাও। কর্ণ বললেন, আমার কবচ-কুণ্ডলের পরিবর্তে আমাকে অব্যর্থ শক্তি অস্ত্র দিন যাতে শত্রসংঘ ধ্বংস করা যায়।

ইন্দ্র একটু চিন্তা করে বললেন, আমার শক্তি অস্ত্র তোমাকে দেবো, কিন্তু তুমি তা নিক্ষেপ করলে একজন মাত্র শত্রুকে বধ করে সেই অস্ত্র আমার কাছে ফিরে আসবে। কর্ণ বললেন, আমি মহাযুদ্ধে একজন শত্রুকেই বধ করতে চাই, যাকে আমি ভয় করি। ইন্দ্র বললেন, তুমি এক শত্রুকে মারতে চাও, কিন্তু লোকে যাকে হরি, নারায়ণ, অচিন্ত্য, প্রভৃতি বলে ভজনা করে সেই কৃষ্ণ তাকে রক্ষা করেন। কর্ণ বললেন, যাই হোক আপনি আমাকে অমোঘ শক্তি দিন যাতে একজন প্রতাপশালী শত্রুকে বধ করা যায়। আমি আমার কবচ ও কুণ্ডল আপনাকে দেবো, কিন্তু আমার অঙ্গ যেন বিকৃত না হয়। ইন্দ্র বললেন, তোমার দেহের কোনও বিকৃতি হবে না। কিন্তু অন্য অস্ত্র থাকতে অথবা তোমার প্রাণসংশয় না হোলে যদি অসাবধানে এই অস্ত্র প্রয়োগ করো তবে তোমার উপরেই আঘাত করবে। কর্ণ বললেন, আমি সত্য বলছি,  প্রাণসংশয় হলেই আমি এই অস্ত্র প্রয়োগ করবো।

ইন্দ্রের কাছ থেকে শক্তি অস্ত্র নিয়ে কর্ণ নিজের কবচ ও কুণ্ডল কেটে ইন্দ্রকে দিলেন, তা দেখে দেবতা, দানব, মানব সকলেই চীৎকার কোরে উঠল। কিন্তু কর্ণের মুখে কোনও বিকৃতি দেখা গেল না। কর্ণের কবচ ও কুণ্ডল নিয়ে ইন্দ্ৰ সহাস্যে চলে গেলেন। এই দানের ফলে কর্ণ যশস্বী হয়েছেন, পাণ্ডবরাও উপকৃত হয়েছেন।

______________

(ক্রমশ)