মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৭৯
দুর্যোধনাদীর বিরাটের রাজ্য আক্রমণের মন্ত্রণার কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
দুর্যোধনাদীর বিরাটের রাজ্য আক্রমণের মন্ত্রণার কাহিনি
পাণ্ডবরা কোথায় অজ্ঞাতবাস করছেন তা জানবার জন্য দুর্যোধন নানা দেশে চর পাঠিয়েছিলেন। তারা এখন হস্তিনাপুরে ফিরে এসে তাকে বললে, মহারাজ, আমরা বিভিন্ন দুর্গম বনে, পর্বতে, জনাকীর্ণ দেশে ও নগরে নানাভাবে খোঁজ করেও পাণ্ডবদের দেখা পাইনি। তাদের সারথিরা দ্বারকায় গেছে, কিন্তু তারা সেখানে নেই। পাণ্ডবগণ নিশ্চয় মারা গেছেন। একমাত্র সুসংবাদ এই যে, মৎস্যরাজ বিরাটের সেনাপতি দুরাত্মা কীচক, যিনি ত্রিগর্ত দেশের বীরগণকে বার বার পরাজিত করেছিলেন তিনি আর জীবিত নেই। শুনেছি গন্ধর্বেরা একদিন রাতে এসে তাকে এবং তার বন্ধু উপকীচকদের বধ করেছে।
দুর্যোধন সভায় উপস্থিত সবাইকে বললেন, পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের আর মাত্র কয়েক দিন অবশিষ্ট আছে, এই সময়ের মধ্যে যদি তাদেরকে খুজেঁ না পাওয়া যায় তবে তাদের সত্য রক্ষা হবে এবং তার ফল কৌরবদের পক্ষে দুঃখজনক হবে। এখন এর প্রতিকারের জন্য কি করা উচিত তা আপনারা শীঘ্র স্থির করুন। কর্ণ বললেন, আর একদল অতি ধূর্ত গুপ্তচর পাঠাও, তারা সব জায়গায় গিয়ে খোঁজ করুক। দুঃশাসন বললেন আমারও সেই মত, পাণ্ডবরা হয়তো আত্মগোপন কোরে আছে বা সমুদ্রের অপর পারে গেছে বা বনের হিংস্র পশু তাদের খেয়ে ফেলেছে অথবা অন্য কোনও বিপদের ফলে তাদের বিনাশ হয়েছে।
দ্রোণাচার্য বললেন, পাণ্ডবদের ন্যায় বীর ও বুদ্ধিমান পুরুষরা কখনও বিনষ্ট হন না, আমি মনে করি তারা সাবধানে অজ্ঞাতবাস সম্পন্ন হওয়ার অপেক্ষা করছেন। তোমরা ভালোভাবে চিন্তা কোরে যা যুক্তিসঙ্গত তাই করো। ভীষ্ম বললেন, দ্রোণাচার্য ঠিক বলেছেন, পাণ্ডবগণ কৃষ্ণের অনুগত, ধর্মবলে ও আত্মশক্তিতে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম, তারা উপযুক্ত কালের অপেক্ষা করছেন। তাদের অজ্ঞাতবাস সম্বন্ধে অন্য লোকের যে ধারণা, আমার তা নয়। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির যে দেশেই থাকুন, সেই দেশের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল হবে, কোনও গুপ্তচর তার সন্ধান পাবে না। কৃপাচার্য বললেন, পাণ্ডবদের আত্মপ্রকাশের কাল আসন্ন, সময় উত্তীর্ণ হোলেই তারা নিজ রাজ্য অধিকারের জন্য উৎসাহী হবেন। দুর্যোধন, তুমি নিজের শক্তি ও ধন বৃদ্ধি করো, তার পর অবস্থা বুঝে সন্ধি বা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ো।
ত্রিগর্তদেশের রাজা সুশর্মা দুর্যোধনের সভায় উপস্থিত ছিলেন, মৎস্য দেশের যোদ্ধারা তাঁকে বহুবার পরাজিত করেছিল। তিনি দুর্যোধনকে বললেন, মৎস্যরাজ বিরাট আমার রাজ্যে অনেক বার আক্রমণ করেছেন, মহাবীর কীচক তাঁর সেনাপতি ছিলেন। সেই নিষ্ঠুর দুরাত্মা কীচককে গন্ধর্বরা বধ করেছে, তার ফলে বিরাট এখন অসহায় ও দুর্বল হয়েছেন। আমার মতে এখন বিরাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করা উচিত। আমরা তার ধনরত্ন, গ্রামসমূহ বা রাজ্য অধিকার করবো, লক্ষাধিক গরু হরণ করবো, কিংবা তার সঙ্গে সন্ধি করে তার গৌরব নষ্ট করবো অথবা তার সমস্ত সৈন্য বিনাশ কোরে তাকে বশে আনব। তাতে আপনার শক্তিবৃদ্ধি হবে।
কর্ণ বললেন, সুশর্মা ভালো কথা বলেছেন। আমাদের সেনাদল একসঙ্গে বা বিভক্ত হয়ে যাত্রা করুক। ধনহীন, বলহীন, পৌরুষহীন পাণ্ডবদের জন্য আমাদের ভাববার প্রয়োজন নেই, তারা গায়েব হয়ে গেছে অথবা যমালয়ে গেছে। এখন আমরা নিশ্চিন্তে বিরাটরাজ্য আক্রমণ করে গরু এবং বিবিধ ধনরত্ন হরণ করবো। কর্ণের প্রস্তাবে সবাই সম্মতি জানালে, কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমীর দিন সুশর্মা সসৈন্যে বিরাটরাজ্যের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে উপস্থিত হলেন। পরদিন কৌরবগণও সসৈন্যে বিরাটরাজ্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন।
______________
(ক্রমশ)