Story of Mahabharat Part 88 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 88

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 88

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৮৮

কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে যুদ্ধের বিষয়ে কৌরবসভায় বিতর্কের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে যুদ্ধের বিষয়ে কৌরবসভায় বিতর্কের কাহিনি

ধৃতরাষ্ট্রের অনুরোধে সনৎকুমার ধর্ম ও মোক্ষ বিষয়ে বহু উপদেশ দেওয়ার পর ধৃতরাষ্ট্র বিদুর ও সনৎকুমারের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা কোরে সারা রাত কাটিয়ে দিলেন। পরদিন তিনি রাজসভায় উপস্থিত হয়ে ভীষ্ম, দ্রোণ, দুর্যোধন, কর্ণ প্রভৃতির সঙ্গে মিলিত হলেন। সকলে আসন গ্রহণ করলে সঞ্জয় যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে তার দৌত্যের বৃত্তান্ত সবিস্তারে বর্ণনা করলেন।

ভীষ্ম বললেন, আমি শুনেছি দেবগণের আবির্ভাবের আগে নর ও নারায়ণ ঋষিদ্বয় অর্জুন ও কৃষ্ণ রূপে জন্মগ্রহণ করেছেন, এঁরা দেবতা ও অসুরেরও অজেয়। বৎস দুর্যোধন, ধর্ম থেকে তোমার বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়েছে, যদি আমার কথা গ্রাহ্য না করো তবে বহুলোকের মৃত্যু হবে। পরশুরাম যাঁকে অভিশাপ দিয়েছিলেন সেই কর্ণ, কপট শকুনি এবং নীচ পাপিষ্ঠ দুঃশাসন, তুমি কেবল এই তিনজনের মতে চলো।

কর্ণ বললেন, পিতামহ, আমি ক্ষত্রধর্ম পালন করি, ধর্ম থেকে ভ্রষ্ট হইনি, আমার কি দুষ্কর্ম দেখেছেন যে নিন্দা করছেন? আমি সকল পাণ্ডবকে যুদ্ধে বধ করবো। যাদের সঙ্গে পূর্বে বিরোধ হয়েছে তাদের সঙ্গে আর সন্ধি হতে পারে না। ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, এই দুর্মতি কর্ণের জন্যই তোমার দুরাত্মা পুত্ররা বিপদে পড়বে। বিরাটনগরে যখন এঁর ভাই অর্জুনের হাতে নিহত হয়েছিল তখন কর্ণ কি করছিল? কৌরবগণকে পরাজিত কোরে অর্জুন যখন তাদের পোশাক খুলে নিয়েছিল তখন কর্ণ কি বিদেশে ছিল? গন্ধর্বরা যখন তোমার পুত্রকে বন্দী করেছিল তখন কর্ণ কোথায় ছিল? এখন এই কর্ণ কোন বুদ্ধিতে ষাঁড়ের মতো আস্ফালন করছে?

মহামতি দ্রোণ বললেন, মহারাজ, ভীষ্ম যা বলবেন আপনি তাই করুন। অহংকারী মূর্খ লোকের কথা শুনবেন না। যুদ্ধের আগেই পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করা উচিৎ মনে করি, কারণ অর্জুনের তুল্য ধনুর্ধর ত্রিভুবনে নেই। ভীষ্ম ও দ্রোণের কথায় ধৃতরাষ্ট্র কান দিলেন না, তাদের সঙ্গে কথাও বললেন না, কেবল সঞ্জয়কে প্রশ্ন করতে লাগলেন।

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, সঞ্জয়, আমাদের বহু সৈন্য সমবেত হয়েছে শুনে যুধিষ্ঠির কি বললেন? কারা তার আজ্ঞার অপেক্ষা করছেন? কারা তাকে যুদ্ধ থেকে বিরত হতে বলছেন? সঞ্জয় বললেন, যুধিষ্ঠিরের ভাইয়েরা, পাঞ্চালদেশের রাজা, কেকয়দেশের রাজা, মৎস্যদেশের রাজা, গোপালক ও মেষপালকেরা, সকলেই যুধিষ্ঠিরের অনুগত। সঞ্জয় দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে যেন কিছু চিন্তা করতে লাগলেন এবং সহসা মূৰ্ছিত হলেন। বিদুরের মুখে সঞ্জয়ের অবস্থা শুনে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, পাণ্ডবরা এঁকে শঙ্কিত করেছেন।

কিছুক্ষণ পরে সুস্থ হয়ে সঞ্জয় বললেন, মহারাজ, যুধিষ্ঠিরের মহাবল ভাইয়েরা, মহাতেজা দ্রুপদ ও তাঁর পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী যিনি পূর্বজন্মে কাশীরাজের কন্যা ছিলেন এবং ভীষ্মের বধকামনায় তপস্যা করে দ্রুপদের কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করে পরে পুরুষ হয়েছেন, কেকয়রাজের পাঁচ পুত্র, মহাবীর সাত্যকি, কাশীরাজ, দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র, কৃষ্ণের মতো বলবান অভিমন্যু, শিশুপালের পুত্র ধৃষ্টকেতু ও শরভ, জরাসন্ধপুত্র সহদেব ও জয়ৎসেন এবং স্বয়ং কৃষ্ণ - এঁরাই যুধিষ্ঠিরের সহায়।

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, আমি ভীমকে সবচেয়ে ভয় করি, সে ক্ষমা করে না, শত্রুকে ভোলে না, পরিহাস শুনেও হাসে না। উদ্ধতস্বভাব মহাবলী ভীম গদাঘাতে আমার পুত্রদের বধ করবে। পাণ্ডবরা জয়ী হবে জেনেও আমি পুত্রদের বারণ করতে পারছি না, কারণ মানুষের ভাগ্যই বলবান। পাণ্ডবগণ যেমন ভীষ্মের পৌত্র এবং দ্ৰোণ ও কৃপের শিষ্য, আমার পুত্রগণও তেমন। ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপ এই তিন বৃদ্ধ আমার আশ্রয়ে আছেন, এঁরা সজ্জন, যা কিছু এঁদের দান করেছি তার প্রতিদান এঁরা নিশ্চয় করবেন। এঁরা আমার পুত্রের পক্ষে থাকবেন এবং যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত সৈন্যগণের নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু দ্রোণ ও কর্ণ অর্জুনের বিপক্ষে দাঁড়ালেও জয় সম্বন্ধে আমার সংশয় রয়েছে, কারণ কর্ণ ক্ষমাশীল ও অসতর্ক এবং দ্রোণাচার্য বৃদ্ধ ও অর্জুনের গুরু। শুনেছি কৃষ্ণ, অর্জুন ও গাণ্ডীব ধনু এই তিন তেজ একই রথে থাকবে। আমাদের তেমন সারথি নেই, যোদ্ধা নেই, ধনুও নেই। কৌরবগণ, যুদ্ধ করা আমি ভাল মনে করি না। আপনারা ভেবে দেখুন, যদি আপনাদের মত হয় তবে আমি শান্তির চেষ্টা করবো।

সঞ্জয় বললেন, মহারাজ, আপনি ধীরবুদ্ধি, অর্জুনের পরাক্রমও জানেন, তবুও কেন পুত্রদের কথায় চলেন জানি না। পাশা খেলার সভায় পাণ্ডবদের প্রতিবার পরাজয় শুনে আপনি হেসেছিলেন। তাদের যে কটুকথা বলা হয়েছিল আপনি তার প্রতিবাদ করেননি। তারা যখন বনে যান তখনও আপনি বার বার হেসেছিলেন। এখন আপনি অসহায়ের মতো বৃথা বিলাপ করছেন। ভীম ও অর্জুন যাঁর পক্ষে যুদ্ধ করবেন তিনিই জয়ী হবেন। এখন আপনার দুরাত্মা পুত্র ও তার অনুগামীদের যে কোনো উপায়ে যুদ্ধ থেকে নিরস্ত করুন।

দুর্যোধন বললেন, মহারাজ, ভয় পাবেন না। পাণ্ডবরা বনে গেলে কৃষ্ণ, কেকয়গণ, ধৃষ্টকেতু, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও বহু রাজা সসৈন্যে ইন্দ্রপ্রস্থের নিকটে এসে আমাদের নিন্দা করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, পাণ্ডবদের উচিত কৌরবদের উচ্ছেদ করে পুনর্বার রাজ্য অধিকার করা। গুপ্তচরের মুখে এই সংবাদ পেয়ে আমার ধারণা হয় যে পাণ্ডবরা তাদের বনবাসের প্রতিজ্ঞা পালন করবেন না, যুদ্ধে আমাদের পরাস্ত করবেন। সেই সময়ে আমাদের মিত্র ও প্রজারা সকলেই ক্রুদ্ধ হয়ে আমাদের ধিক্কার দিচ্ছিল। তখন আমি ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ ও অশ্বত্থামাকে বললাম, পিতা আমার জন্য দুঃখ ভোগ করছেন, অতএব সন্ধি করাই ভাল। তাতে ভীষ্ম ও দ্রোণাদি আমাকে আশ্বাস দিলেন, ভয় পেয়ো না, যুদ্ধে কেউ আমাদের জয় করতে পারবে না। মহারাজ, অমিততেজা ভীষ্ম ও দ্রোণাদির তখন এই দৃঢ় ধারণা ছিল। এখন পাণ্ডবগণ আগের চেয়ে শক্তিহীন হয়েছে, সমস্ত পৃথিবী আমাদের অধিকারে এসেছে, যে রাজারা আমাদের পক্ষে যোগ দিয়েছেন তারা সুখে দুঃখে আমাদের সঙ্গেই থাকবেন, অতএব আপনি ভয় দুর করুন। আমাদের বিশাল সৈন্যসমাবেশে যুধিষ্ঠির ভয় পেয়েছেন তাই তিনি কেবল পাঁচটি গ্রাম চেয়েছেন, তার রাজধানী চাননি। ভীমের শক্তি সম্বন্ধে আপনি যা মনে করেন তা মিথ্যা। আমি যখন বলরামের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করতাম তখন সকলে বলত গদাযুদ্ধে আমার সমান পৃথিবীতে কেউ নেই। আমি এক আঘাতেই ভীমকে যমালয়ে পাঠাব। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, কর্ণ, ভূরিশ্রবা, শল্য, ভগদত্ত ও জয়দ্রথ — এঁদের যে কেউ পাণ্ডবদের বধ করতে পারেন, এঁরা মিলিত ভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের যমালয়ে পাঠাবেন। কর্ণ ইন্দ্রের কাছ থেকে অমোঘ শক্তি অস্ত্র লাভ করেছেন। সেই কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধে অর্জুন কি করে বাঁচবেন? আমাদের যে দশ কোটি সংশপ্তক সৈন্য আছে তারা প্রতিজ্ঞা করেছে - হয় আমরা অর্জুনকে মারব, না হয় তিনি আমাদের মারবেন। আমাদের এগার অক্ষৌহিণী সেনা, আর পাণ্ডবদের সাত অক্ষৌহিণী। তাহলে আমাদের পরাজয় হবে কেন? বৃহস্পতি বলেছেন, শত্রুর সেনা যদি এক তৃতীয়াংশ কম হয়, তবে তার সঙ্গে যুদ্ধ করবে। আমাদের সেনা বিপক্ষের সেনার চেয়ে অনেক বেশী। মহারাজ, পাণ্ডবদের শক্তি আমাদের তুলনায় অনেক কম।

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, আমার পুত্র পাগলের মতো প্রলাপ বকছে, এ কখনও ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে জয় করতে পারবে না। পাণ্ডবদের শক্তি ভীষ্ম সঠিক ভাবে জানেন, সেজন্যই উনি যুদ্ধ চাইছেন না। সঞ্জয়, যুদ্ধের জন্য পাণ্ডবগণকে কে উত্তেজিত করছে? সঞ্জয় বললেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন। তিনিই পাণ্ডবগণকে উৎসাহ দিচ্ছেন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, দুর্যোধন, যুদ্ধ হতে নিরস্ত হও, অর্ধেক রাজ্যই তোমাদের জন্য যথেষ্ট, পাণ্ডবগণকে তাদের ন্যায্য ভাগ দাও। আমি যুদ্ধ চাই না, ভীষ্ম ও দ্রোণাদিও চাইছেন না।

দুর্যোধন বললেন, আপনার অথবা ভীষ্ম ও দ্রোণাদির ভরসায় আমি শক্তি সংগ্রহ করিনি। আমি, কর্ণ ও দুঃশাসন, আমরা এই তিন জনেই পাণ্ডবদের বধ করবো। আমি জীবন, রাজ্য ও সমস্ত ধন ত্যাগ করবো, কিন্তু পাণ্ডবদের সঙ্গে বাস করবো না। সূঁচের অগ্রভাগ দিয়ে যে পরিমাণ ভূমি স্পর্শ করা যায়, তাও আমি পাণ্ডবদেরকে দেবো না।

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, আমি দুর্যোধনকে ত্যাগ করলাম, সে যমালয়ে যাবে। যারা তার সঙ্গে সহয়োগিতা করবে তাদের জন্যই আমার দুঃখ হচ্ছে। দেবতারা পাণ্ডবদের পিতা, তাঁরা পুত্রদের সাহায্য করবেন এবং ভীষ্ম ও দ্রোণাদির প্রতি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হবেন। দেবতাদের সঙ্গে মিলিত হলে পাণ্ডবদের কেউ কোনও অনিষ্ট করতে পারবে না।

দুর্যোধন বললেন, দেবতারা কাম, দ্বেষ, লোভ, মোহ প্রভৃতি ত্যাগ করেই দেবতা হয়েছেন, তাই তারা পুত্রদের সাহায্য করবেন না। যদি করতেন তবে পাণ্ডবরা এত কাল কষ্ট পেতেন না। দেবতারা আমার উপর বিক্রম প্রকাশ করবেন না, কারণ আমিও পরাক্রমশালী। আমি মন্ত্রবলে আগুন নেভাতে পারি, ভূমি বা পর্বত বিদীর্ণ হলে আমি আগের মতো জুড়ে দিতে পারি, শিলাবৃষ্টি ও প্রবল বাতাস নিবারণ করতে পারি, জল স্তম্ভিত করে তার উপর দিয়ে রথ ও পদাতিক সেনা নিয়ে যেতে পারি। দেবতা, গন্ধর্ব ,অসুর বা রাক্ষস কেউ আমার শত্রুকে রক্ষা করতে পারবে না। আমি যা বলি তা সর্বদাই সত্য হয়, সেজন্য লোকে আমাকে সত্যবাক বলে।

কর্ণ বললেন, আমি পরশুরামের কাছে যে ব্রহ্মাস্ত্র পেয়েছি তাতেই পাণ্ডবগণকে সবান্ধবে সংহার করবো। আমি পরশুরামকে নিজের মিথ্যা পরিচয় দিয়েছিলাম সেজন্য তিনি শাপ দেন — অন্তিমকালে এই ব্রহ্মাস্ত্র তোমার স্মরণে আসবে না। তার পর তিনি আমার উপর প্রসন্ন হয়েছিলেন। আমার আয়ু এখনও অবিশষ্ট আছে, ব্রহ্মাস্ত্রও আছে, অতএব পাণ্ডবদের নিশ্চয় জয় করবো। মহারাজ, ভীষ্ম ও দ্রোণাদি আপনার কাছেই থাকুন, পরশুরামের আশীর্বাদে আমিই সসৈন্যে গিয়ে পাণ্ডবদের বধ করবো।

ভীষ্ম বললেন, কর্ণ, যমরাজ তোমার বুদ্ধি নষ্ট করেছেন, তাই গর্ব করছ। তোমার ইন্দ্রদত্ত শক্তি অস্ত্র কৃষ্ণের সুদর্শন চক্রের আঘাতে নষ্ট হবে। যে সর্পমুখ বাণকে তুমি নিত্য পূজা করো তা অর্জুনের বাণে তোমার সঙ্গেই বিনষ্ট হবে। যিনি বাণ ও নরক অসুরকে হত্যা করেছেন, যিনি তোমার অপেক্ষাও পরাক্রান্ত শত্রুকে বধ করেছেন, সেই কৃষ্ণই অর্জুনকে রক্ষা করবেন।

কর্ণ বললেন, মহাত্মা কৃষ্ণের প্রভাব নিশ্চয়ই প্রবল কিংবা আরও অধিক। কিন্তু পিতামহ ভীষ্ম আমাকে কটুকথা বলেছেন, সেজন্য আমি অস্ত্র ত্যাগ করলাম। ইনি যুদ্ধে বা এই সভায় আমাকে দেখতে পাবেন না। এঁর মৃত্যুর পর পৃথিবীর সকল রাজা আমার পরাক্রম দেখবেন। এই বলে কর্ণ সভা থেকে চলে গেলেন।

ভীষ্ম সহাস্যে বললেন, কর্ণ সত্যপ্রতিজ্ঞ, কিন্তু কি করে তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবে? এই নরাধম যখন নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে পরশুরামের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখেছিল তখনই এর ধর্ম আর তপস্যা নষ্ট হয়েছে।

ধৃতরাষ্ট্র তার পুত্রকে অনেক উপদেশ দিলেন, সঞ্জয়ও নানাপ্রকারে বোঝালেন যে পাণ্ডবদের জয় অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু দুর্যোধন তাদের উপদেশে কর্ণপাত করলেন না।

______________

(ক্রমশ)