Story of Mahabharat Part 96 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 96

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 96

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৯৬

দুর্যোধনকে গান্ধারীর উপদেশ এবং কৃষ্ণের সভাত্যাগের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

দুর্যোধনকে গান্ধারীর উপদেশ এবং কৃষ্ণের সভাত্যাগের কাহিনি

কৃষ্ণের বক্তব্য শুনে ধৃতরাষ্ট্র ব্যস্ত হয়ে বিদুরকে বললেন, গান্ধারীকে এখানে ডেকে আনো, আমি আর গান্ধারী দুʼজনে একসঙ্গে দুর্যোধনকে বোঝাব। গান্ধারী এলে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, তোমার দুরাত্মা অবাধ্য পুত্রের লোভের কারণে রাজ্য ও অসংখ্য প্রাণ চলে যাবে।

গান্ধারী বললেন, অশিষ্ট দুর্বিনীত ধর্মনাশক লোকের রাজ্য পাওয়া উচিত নয় তথাপি সে পেয়েছে। মহারাজ, তুমিই দোষী, পুত্রের দুষ্ট প্রবৃত্তি জেনেও স্নেহবশে তার মতে চলেছ, মূর্খ দুরাত্মা লোভী কুসঙ্গী পুত্রকে রাজ্য দিয়ে এখন তার ফল ভোগ করছো।

ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে বিদুর দুর্যোধনকে আবার সভায় নিয়ে এলেন। গান্ধারী বললেন, পুত্র, তোমার পিতা, ভীষ্ম ও দ্রোণাদি শুভানুধ্যায়ীদের কথা রাখো। রাজত্বের অর্থ মহৎ প্রভুত্ব, দুরাত্মারা এই পদ কামনা করে কিন্তু রাখতে পারে না। যে লোক কামনা বা ক্রোধের বশে আত্মীয় বা অন্যের প্রতি অন্যায় আচরণ করে, কেউ তার সহায় হয় না। পাণ্ডবগণ ঐক্যবদ্ধ মহাপ্রাজ্ঞ বীর, তাদের সঙ্গে মিলিত হলে তুমি সুখে পৃথিবী ভোগ করতে পারবে। বৎস, ভীষ্ম ও দ্রোণ যা বলেছেন তা সত্য, কৃষ্ণ ও অর্জুন অজেয়। তুমি কৃষ্ণের শরণাপন্ন হও, তা হলে তিনি উভয় পক্ষের মঙ্গল করবেন। যুদ্ধে কল্যাণ নেই, ধর্ম বা অর্থ নেই, সুখ নেই, সর্বদা জয়ও হয় না। তুমি তেরো বছর পাণ্ডবদের প্রচুর অনিষ্ট করেছ, তোমার লোভ আর ক্রোধের জন্য তা বেড়ে গেছে, এখন তার প্রায়শ্চিত্ত করো। মূর্খ, তুমি মনে করো ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ প্রভৃতি তোমার জন্য যুদ্ধে সর্ব শক্তি প্রয়োগ করবেন, কিন্তু তা হবে না। কারণ, এই রাজ্যে তোমাদের আর পাণ্ডবদের সমান অধিকার, দুই পক্ষের সঙ্গেই এঁদের সমান স্নেহের সম্বন্ধ, কিন্তু পাণ্ডবরা অধিকতর ধর্মশীল। ভীষ্মাদি তোমার অন্নে পালিত সেজন্য জীবন বিসর্জন দিতে পারেন, কিন্তু যুধিষ্ঠিরকে শত্রুরূপে দেখতে পারবেন না। বৎস, কেবল লোভ করলে সম্পদ লাভ হয় না, লোভ ত্যাগ করো, শান্ত হও।

মায়ের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে দুর্যোধন ক্রুদ্ধ হয়ে শকুনি, কর্ণ ও দুঃশাসনের কাছে গেলেন। তারা মন্ত্রণা করে স্থির করলেন, কৃষ্ণ ক্ষমতাশালী, তিনি ধৃতরাষ্ট্র আর ভীষ্মের সঙ্গে মিলিত হয়ে আমাদের বন্দী করতে চান। অতএব আমরাই আগে তাঁকে সবলে বন্দী করবো, তাতে পাণ্ডবরা হতভম্ব ও নিরুৎসাহ হয়ে পড়বে। ধৃতরাষ্ট্র ক্রুদ্ধ হয়ে বারণ করলেও আমরা কৃষ্ণকে বন্দী কোরে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করবো।

দুর্যোধনাদির এই অভিসন্ধি বুঝতে পেরে সাত্যকি সভা থেকে বেরিয়ে কৃতবর্মাকে বললেন, শীঘ্র আমাদের সৈন্য সন্নিবেশ করো এবং বর্ম ধারণ করে তুমি এই সভার দ্বারদেশে থাকো। তার পর সাত্যকি সভায় গিয়ে কৃষ্ণ, ধৃতরাষ্ট্র ও বিদুরকে দুর্যোধনাদির অভিসন্ধি জানিয়ে বললেন, বালক ও জড়বুদ্ধি যেমন কাপড় দিয়ে জ্বলন্ত আগুন নিভাতে চায়, এই মূর্খগণ তেমন কৃষ্ণকে বন্দী করতে চাচ্ছে। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, মহারাজ, আপনার পুত্রেরা কালের কবলে পড়েছে, তারা গর্হিত ও অসাধ্য কাজ করতে যাচ্ছে।

কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, এরা যদি আমাকে সবলে বন্দী করতে চায় তবে আপনি অনুমতি দিন, এরা আমাকে বন্দী করুক কিংবা আমিই এদের বন্দী করি। আমি এদের সকলকে বন্দী কোরে পাণ্ডবদের হাতে দিতে পারি, তাতে অনায়াসে তাদের কার্যসিন্ধি হবে। কিন্তু আপনার সামনে আমি এই নিন্দিত কাজ করবো না। আমি অনুমতি দিচ্ছি, দুর্যোধন যা ইচ্ছা হয় করুক।

দুর্যোধনকে আবার ডেকে আনিয়ে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, নৃশংস পাপিষ্ঠ, তুমি ক্ষুদ্রবুদ্ধি পাপাত্মাদের সাহায্যে পাপকর্ম করতে চাইছ! যেমন হাত দিয়ে বাতাসকে ধরা যায় না, চাঁদকে স্পর্শ করা যায় না, মাথা দিয়ে পৃথিবী ধারণ করা যায় না, তেমন কৃষ্ণকেও সবলে বন্দী করা যায় না।

কৃষ্ণ বললেন, দুর্যোধন, তুমি মোহবশে মনে করছো আমি একা, তাই আমাকে সবলে বন্দী করতে চাইছ। আমার দিকে তাকিয়ে দেখো — পাণ্ডবগণ, অন্ধক ও বৃষ্ণিবংশীয়গণ, আদিত্য, রুদ্র ও বসুগণ, মহর্ষিগণ, সকলেই এখানে আছেন। এই বলে কৃষ্ণ জোরে হাসলেন। তখন সহসা তার কপাল থেকে ব্রহ্মা, বুক থেকে রুদ্র, মুখ থেকে অগ্নিদেব এবং অন্যান্য অঙ্গ থেকে ইন্দ্রাদি দেবতা, যক্ষ, রক্ষ, গন্ধর্ব, প্রভৃতি, হলধর বলরাম ও পঞ্চপাণ্ডব আবির্ভূত হলেন। অস্ত্র উদ্যত করে অন্ধক ও বৃষ্ণিবংশীয় বীরগণ তাঁর সম্মুখে এলেন এবং শঙ্খ চক্র গদা শক্তি শাঙ্গনু প্রভৃতি সর্বপ্রকার অস্ত্র উপস্থিত হোলো। সহস্র চরণ, সহস্র,বাহু, সহস্র নয়ন কৃষ্ণের ঘোর মূর্তি দেখে সভাস্থ সকলে ভয়ে চোখ বুজলেন, কেবল ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর সঞ্জয় ও ঋষিরা চেয়ে রইলেন, কারণ কৃষ্ণ তাঁদের দিব্যচক্ষু দিয়েছিলেন। ধৃতরাষ্ট্রও দিব্যদৃষ্টি পেয়ে কৃষ্ণের পরম রূপ দেখলেন। দেবতা গন্ধর্ব ঋষি প্রভৃতি প্রণাম করে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, প্রভু, প্রসন্ন হও, তোমার রূপ সংবরণ করো, নতুবা জগৎ বিনষ্ট হবে। তখন কৃষ্ণ আগের রূপে ফিরে এলেন এবং ঋষিদের অনুমতি নিয়ে সাত্যকি আর বিদুরের হাত ধরে সভা থেকে বেরিয়ে এলেন। নারদাদি মহর্ষিগণও চলে গেলেন।

রথে উঠে কৃষ্ণ যখন প্রস্থানের উদ্যোগ করছিলেন তখন ধৃতরাষ্ট্র তার কাছে এসে বললেন, কৃষ্ণ, পুত্রদের উপর আমার কতটুকু প্রভাব তা তুমি দেখলে। আমার দুরভিসন্ধি নেই, দুর্যোধনকে যা বলেছি তা তুমি শুনেছ। সকলেই জানে যে আমি সর্বতোভাবে শান্তির চেষ্টা করেছি।

ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম ও দ্রোণাদিকে কৃষ্ণ বললেন, কৌরবসভায় যা হোলো তা আপনারা দেখলেন, দুর্যোধন আমাকে বন্দী কবার চেষ্টা করেছে তাও জানেন। ধৃতরাষ্ট্রও বলছেন তার কোনও প্রভুত্ব নেই। এখন আপনারা আজ্ঞা দিন আমি যুধিষ্ঠিরের কাছে ফিরে যাবো। এই বলে কৃষ্ণ কুন্তীর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন।

______________

(ক্রমশ)