. শান্তিনিকেতনের ছায়ায়
শান্তিনিকেতনের পাশের ছোট্ট শহর, যেখানে শিমুল আর কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় গড়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের ক্যাম্পাস। সেই ক্যাম্পাসেই কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সায়ন্তন—কবিতার জাদুকর, যার কলমে জন্ম নেয় ভালোবাসা, বিচ্ছেদ, আর স্বপ্নের গল্প। অন্যদিকে ঋক্তা—একজন মেধাবী চিত্রশিল্পী, যার তুলিতে ফুটে ওঠে জীবনের রং, বেদনা, আর অনন্ত অপেক্ষা।
দু’জনের প্রথম দেখা হয় বসন্ত উৎসবে। সায়ন্তনের কবিতা পাঠের মাঝে ঋক্তার আঁকা ছবিগুলো প্রদর্শিত হচ্ছিল। কবিতার প্রতিটি শব্দ যেন ঋক্তার ছবির রঙে মিশে গিয়েছিল। সেই সন্ধ্যায় তারা বুঝতে পারে—তাদের শিল্প, তাদের স্বপ্ন, তাদের মন—সবই যেন একসূত্রে বাঁধা।
২. প্রেমের অঙ্গীকার
ক্যাম্পাসের বটগাছের ছায়ায় বসে তারা প্রতিজ্ঞা করে—কোনো ঝড়ই তাদের আলাদা করতে পারবে না। সায়ন্তন বলে,
"তুমি আমার কবিতার প্রাণ, ঋক্তা। তুমি ছাড়া আমার শব্দেরা অর্থহীন।"
ঋক্তা হাসে, "তুমি না থাকলে আমার রঙও ফিকে হয়ে যায়।"
তাদের বন্ধুত্বের গভীরতা দ্রুতই প্রেমে রূপ নেয়। তারা একসাথে স্বপ্ন দেখে—একদিন সায়ন্তনের কবিতার বই প্রকাশ হবে, ঋক্তার ছবি শহরের গ্যালারিতে ঝুলবে। তারা একে অপরের অনুপ্রেরণা, আশ্রয়, আর সাহস।
৩. অদ্ভুত চিঠির আগমন
একদিন, ঋক্তা তার পড়ার টেবিলে একটি চিঠি দেখতে পায়। খামটা পুরনো, কিন্তু তার নিজের নামেই লেখা। চিঠি খুলে সে অবাক—নিজের হাতের লেখা, অথচ সে লেখেনি।
চিঠিতে লেখা—
"ঋক্তা,
আমি তোমার ভবিষ্যতের আমি।
যদি তুমি সায়ন্তনের পাশে থাকো, আগামী পূর্ণিমার রাতে তার মৃত্যু হবে। তাকে বাঁচাতে হলে, তোমাকে আজই তার জীবন থেকে সরে যেতে হবে।
বিশ্বাস করো, আমি জানি—তুমি ভেঙে পড়বে। কিন্তু তার জীবন তোমার ভালোবাসার চেয়েও মূল্যবান।
—তোমারই, সাত বছর পরের ঋক্তা"
ঋক্তা প্রথমে ভেবেছিল, কেউ হয়তো মজা করছে। কিন্তু চিঠির ভাষা, ব্যক্তিগত স্মৃতি, এমনকি কিছু গোপন কথা—সবই শুধু সে আর সায়ন্তন জানে! তার মন অজানা আতঙ্কে ভরে যায়।
৪. দূরত্বের যন্ত্রণা
ঋক্তা কিছু না বলে সায়ন্তনের থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করে। সে ফোন ধরা বন্ধ করে, ক্যাম্পাসে এড়িয়ে চলে, কবিতার খাতাটা ফিরিয়ে দেয়। সায়ন্তন কিছুই বুঝতে পারে না—তার চোখে জমে ওঠে প্রশ্ন, অভিমান, আর অব্যক্ত কান্না।
একদিন, বৃষ্টিভেজা বিকেলে সায়ন্তন এসে বলে,
"তুমি কেন পালিয়ে বেড়াচ্ছো, ঋক্তা? আমি কি কিছু ভুল করেছি?"
ঋক্তা চোখের জল লুকিয়ে বলে,
"আমাদের পথ আলাদা, সায়ন্তন। আমাদের স্বপ্নও আলাদা।"
তারপর সে চলে যায়, আর ফিরে তাকায় না।
৫. বিচ্ছেদের পর
বছর কেটে যায়। সায়ন্তন হয়ে ওঠে বিখ্যাত কবি—তার কবিতার বই ‘অপূর্ণ চিঠি’ শহরজুড়ে আলোড়ন তোলে। তার কবিতায় শুধু বিচ্ছেদ, বেদনা, আর এক অজানা অপেক্ষা।
ঋক্তা একা, নিঃসঙ্গ। তার ক্যানভাসে শুধু ধূসর রঙ। সে আর ছবি আঁকে না, শুধু পুরনো চিঠিটা পড়ে আর কাঁদে।
৬. অতিপ্রাকৃত মোড়
সাত বছর পর, পূর্ণিমার রাতে, হঠাৎ ঋক্তার দরজায় আবার একটি চিঠি।
এবারও তার হাতের লেখা, কিন্তু সে লেখেনি।
চিঠিতে লেখা—
"তুমি কি জানো, ভাগ্য বদলানো যায়?
যদি আজ রাতেই পুরনো বটগাছের নিচে যাও, হয়তো সবকিছু বদলে যাবে।
—তোমারই, অন্য এক ভবিষ্যত থেকে"
ঋক্তার মন দ্বিধায় ভরে যায়। সে কি সত্যিই ভাগ্য বদলাতে পারবে? নাকি সবকিছুই কাকতালীয়?
৭. শেষ সন্ধ্যা
ঋক্তা ছুটে যায় ক্যাম্পাসের বটগাছের নিচে। সেখানে পৌঁছে দেখে, সায়ন্তনের কবিতার খাতাটা পড়ে আছে, কিন্তু সায়ন্তন নেই।
একজন পুরনো বন্ধু জানায়—
"সায়ন্তন হিমালয়ে ট্রেকিংয়ে গেছে। সে বলেছিল, যদি কখনো ঋক্তা ফিরে আসে, যেন এই খাতাটা তাকে দিই।"
ঋক্তা খাতাটা খুলে দেখে, শেষ পাতায় লেখা—
"তুমি দূরে গিয়ে আমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলে, অথচ আমার কবিতার মৃত্যু হয়েছিল সেই দিনই…
যদি কখনো ফিরে আসো, এই কবিতাগুলো তোমার জন্য রেখে গেলাম।"
৮. রহস্যের শেষ নেই
ঋক্তা জানে না, চিঠিগুলো সত্যিই ভবিষ্যতের, নাকি তার নিজের মনেরই প্রতিচ্ছবি। সে বোঝে, কিছু ভালোবাসা যুক্তির ঊর্ধ্বে, কিছু প্রশ্নের উত্তর কখনোই মেলে না।
সে আবার ছবি আঁকা শুরু করে—সায়ন্তনের কবিতার ছায়ায়, তার স্মৃতির রঙে।
ঋক্তা দীর্ঘদিন পর আবার ছবি আঁকা শুরু করল। ক্যানভাসে ফুটে উঠল সায়ন্তনের কবিতার ছায়া—বিষণ্ণতা, প্রেম, আর অপূর্ণতার রং। তার প্রতিটি তুলির টানে যেন সায়ন্তনের হারিয়ে যাওয়া শব্দেরা ফিরে আসে।
বটগাছের নিচে বসে সে শেষবারের মতো চিঠিগুলো পড়ে, মনে মনে বলে—
"ভালোবাসা কখনোই শেষ হয় না, সে শুধু রূপ বদলায়।"
হিমালয়ের বরফঢাকা শিখরে, হয়তো কোথাও সায়ন্তন তার কবিতার খাতায় লিখে চলে—
"তোমার ভালোবাসা আমাকে বাঁচিয়েছে, ঋক্তা। তুমি দূরে থেকেও আমার শিল্পের প্রাণ।"
ঋক্তা বুঝতে পারে, ভালোবাসা কখনোই কেবল একসাথে থাকার গল্প নয়—এটা স্মৃতি, শিল্প, আর হৃদয়ের গভীরে বেঁচে থাকার নাম।
ভবিষ্যতের চিঠি, অতিপ্রাকৃত রহস্য—সবকিছুর শেষে, ভালোবাসাই সবচেয়ে বড় সত্য।ভালোবাসা কখনোই হারিয়ে যায় না।
কখনো সে স্মৃতিতে, কখনো শিল্পে, কখনো কারও কবিতার অক্ষরে বেঁচে থাকে।
ভাগ্য বা ভবিষ্যতের ভয় নয়—ভালোবাসার সাহসই আমাদের সত্যিকারের মানুষ করে তোলে।
জীবনের প্রতিটি বিচ্ছেদ, প্রতিটি অপূর্ণতা—নতুন কোনো সৃষ্টির, নতুন কোনো গল্পের শুরু।