তুই কি সত্যিই ফিরে এসেছিস?
রুদ্র সেই রাতে ঘুমাতে পারেনি।
ইশা পাশেই ছিল, ওর চুলে হাত বুলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল — কিন্তু রুদ্রের চোখ ছিল ছাদে।
এক অদ্ভুত নিঃশব্দ আগুনের মধ্যে সে পুড়ে যাচ্ছিল।
তুই ওর সঙ্গে দেখা করেছিলি…
তোর চোখে কি আবারও সায়ন ফিরে এলো?
– “তুই ভালোবাসিস তো আমাকে?”
রুদ্র হঠাৎ প্রশ্নটা করে বসে।
ইশা আধো ঘুমের ঘোরে ছিল, একটু চমকে উঠে তাকাল।
– “রাত তিনটের সময় এসব প্রশ্ন আসে কেন তোদের?”
– “কারণ আমি এখন একা বোধ করছি… তোকে পাশে পেয়েও।”
ইশা ধীরে উঠে বসল।
চোখ দুটো ঘুমে ঝাপসা, কিন্তু মনের মধ্যে তখন কিছুটা অপরাধবোধ।
– “আমি যদি বলি… আমি সত্যিই তোকে ভালোবাসি, তবে তুই বিশ্বাস করবি?”
– “বিশ্বাস করব, যদি তুই নিজেকে পুরোপুরি আমার করে তুলিস…”
রুদ্র ধীরে ধীরে তার মুখটা কাছে নিয়ে আসে।
ইশা চোখ বন্ধ করে ফেলে।
সেই চুমু ছিল আবেগের নয় – ছিল দাবির।
রুদ্র আজ আর ইশাকে কেবল আদর করতে চায়নি, চেয়েছিল ওর ভেতরের সব দ্বিধা মুছে দিতে।
তার ঠোঁট গলার নিচে, কাঁধে, বুকের কাছে…
ইশার নিঃশ্বাস কাঁপতে থাকে।
– “তুই আজ শুধু আমার হবি… কারো নয়…”
রুদ্রর শরীরের ভাষা যেন বলে দিচ্ছিল –
“তুই যদি কোথাও ফিরে যাওয়ার কথা ভাবিস, আমি তোকে ছেড়ে দেব না…”
চাদর সরিয়ে ধীরে ধীরে ওর গায়ে ছুঁয়ে যেতে যেতে, রুদ্রর চোখে যেন আগুন লেগে ছিল।
ইশা আর কিছু বলছিল না –
সে শুধু চুপচাপ তার স্পর্শে নিজেকে ভাসিয়ে দিচ্ছিল…
কিন্তু তার হৃদয়ে তখনও একটা কাঁটা।
---
🕰️ পরদিন সকাল
ইশা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কফি বানাচ্ছিল।
পেছন থেকে রুদ্র এসে জড়িয়ে ধরল।
– “কাল রাতে… তুই সত্যিই তো শুধু আমার ছিলি তো?”
ইশা থমকে গেল।
তারপর আস্তে বলল,
– “তুই চাইলে আমি সারাজীবন তোর থাকব…
কিন্তু তুই আমাকে ভালোবাসার নামে শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলিস না, রুদ্র…”
রুদ্র একটু পেছিয়ে গেল।
সে বুঝতে পারল – ইশার ভিতরে কিছু একটা এখনও আটকে আছে।
---
📍 হঠাৎ ফোন বেজে উঠল।
নামটা অচেনা।
📱 “হ্যালো? আপনি কি ইশা মিত্র?”
– “হ্যাঁ, বলছেন?”
📱 “আমি ডঃ শাশ্বত রায়… সায়নের থেরাপিস্ট। ওর অবস্থা আবার খারাপের দিকে যাচ্ছে।
ওর একমাত্র চাওয়া – আপনাকে একবার দেখতে। আপনি কি আসতে পারবেন?”
ইশা এক মুহূর্ত চুপ করে যায়।
সামনে দাঁড়িয়ে রুদ্র।
চোখে একরাশ প্রশ্ন।
“তুই যাচ্ছিস?”
রুদ্রর চোখে তখন আগুন, অথচ ঠোঁটে ঠান্ডা এক হাসি।
– “তুই যাচ্ছিস?”
– “সত্যি বলতে… আমি ঠিক জানি না। আমি কেবল মনে করছি, তার জন্য হয়তো একটা দায়িত্ব রয়ে গেছে।”
– “দায়িত্ব?… আমি জানতাম একদিন তুই আবার চলে যাবি…”
ইশা থমকে গেল।
– “তুই কি আমাকে এতটাই অবিশ্বাস করিস?”
– “তুই যদি বিশ্বাসযোগ্য হতিস, তাহলে আজ আমার পাশে দাঁড়িয়ে অন্য একজনের খোঁজে যেতে পারতিস না।”
সেই কথাটা যেন ইশার বুক চিরে দিল।
সে ধীরে বলল:
– “আমি যাচ্ছি, কারণ আমি ফাইনালি এটুকু বলতে চাই—
আমার কোনো সংশয় নেই এখন।
আমি তোর কাছে ফিরে আসব, রুদ্র।
কারণ তোকে ছাড়া আমার কোনও মানে নেই।”
রুদ্র কিছু বলল না।
সে কেবল তাকিয়ে রইল।
---
📍 ইশা বেরিয়ে পড়ল।
সায়নের ঠিকানার দিকে যেতে যেতে তার মনে পড়ছিল সবকিছু।
– সে কিভাবে প্রথম রুদ্রকে পেয়েছিল
– কিভাবে তার বুকের মধ্যে একটা স্থিরতা জন্ম নিয়েছিল
– কিভাবে সেই স্থিরতাই এখন আবার কাঁপছে…
📱 হঠাৎ ফোন আসে রুদ্রর।
– “হ্যাঁ?”
– “তুই পৌঁছেছিস?”
– “হ্যাঁ, তবে আমি তোর কথাগুলো ভাবছি রুদ্র…”
রুদ্র ধীরে বলল,
– “ভাবিস… কিন্তু তুই ভুলে যাস না—আমি কিন্তু তোর প্রতিটা স্পর্শ, প্রতিটা নিশ্বাস এখনো মনে রেখেছি…
তুই যদি ফিরে না আসিস, আমি আর কাউকে ভালোবাসতে পারব না।”
📞 কল কেটে যায়।
ইশার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
---
📍 সায়নের ফ্ল্যাট
সায়ন এখন আগের চেয়ে ভালো আছে।
ও উঠে বসে।
একটা হালকা চাদর গায়ে জড়ানো।
– “তুই এলি?”
– “তুই কেমন আছিস?”
– “ভালো… তুই এলি বলে…”
ওর চোখে কৃতজ্ঞতা, কিন্তু কোথাও একটা জেদও।
– “তুই জানিস, আমি এখনো তোকে ভালোবাসি?”
– “জানি। কিন্তু তুই জানিস, আমি এখন আর তোরটা নই?”
– “তুই বল, তোর রুদ্র কি তোকে আমার মতো ভালোবাসে?”
ইশা রেগে উঠে দাঁড়াল।
– “তুই আর একটা প্রশ্ন করবি, আমি চলে যাব।
তুই আমায় একবার ছেড়েছিলি। আমি দুবার একই ভুল করব না।”
সায়ন চুপ করে যায়।
– “আমি এসেছি শুধুমাত্র আমার দায়িত্ব বোধ থেকে। কিন্তু তুই যদি আমাকে টেনে ধরতে চাস, তবে আমি তোর সমস্ত স্মৃতি জ্বালিয়ে দেব রুদ্রর চোখের সামনে দাঁড়িয়ে।”
---
📍 রাত্রি – রুদ্রর বাসায় ফিরে আসা
ইশা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।
বেল বাজায়।
দরজা খুলে যায়।
রুদ্র একদম চুপ।
– “আমি ফিরে এসেছি।
তোর জন্য, শুধু তোর জন্য।
আর কখনো পিছনে তাকাব না।”
রুদ্র কিছু বলে না।
ও এগিয়ে এসে শুধু ইশার কপালে ঠোঁট রাখে।
– “এইবার তুই শুধু আমার হবি।
কোনো ছায়া, কোনো স্মৃতি আর না…”
ইশা বলে:
– “তুই যা বলবি, আমি তাই করব।
তুই আমায় আগুনে পুড়িয়ে দিলেও আমি তোর হতে রাজি।”
“তুই শুধু ভালোবাসিস, আমি তোকে জ্বালাতে চাই…”
রুদ্র কিছু না বলে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়।
তারপর ধীরে ধীরে ইশার দিকে এগিয়ে আসে।
চোখে কোনো রাগ নেই, কেবল আগুন।
– “তুই ফিরে এসেছিস…
কিন্তু আমি তোকে ছুঁয়ে না দিলে তোর ফেরাটা আমি বিশ্বাস করব না…”
ইশা চুপ করে ছিল।
সে জানত, এই রুদ্র তার সেই প্রেমিক নয়, যে শুধু কথায় ভালোবাসে —
সে তাকে শরীরে ও আত্মায় স্পর্শ করে, জানিয়ে দেয়— “তুই আমার, কেবল আমার…”
রুদ্রর হাত ধীরে ধীরে ইশার গাল ছুঁয়েছে,
ঠোঁট থেকে গলা পর্যন্ত চুমুতে চুমুতে জেনে নিচ্ছিল –
এই মেয়েটা সত্যিই ফিরেছে কি না…
চাদর সরে যায়।
ইশার চোখে জল, কিন্তু ঠোঁটে থেমে যাওয়ার কোনো ভাষা নেই।
রুদ্র বলে:
– “তুই যদি সত্যিই আমার হবি, তাহলে আজ রাতে আমাকে তোর প্রতিটা নিঃশ্বাসে রেখে দে…”
তারা ধীরে ধীরে বিছানায় গিয়ে বসে।
এই রাতটা ভালোবাসার নয় —
এই রাতটা মুক্তির, দখলের, সমর্পণের।
ইশা ফিসফিসিয়ে বলে:
– “তুই আমায় যেভাবে ছুঁস, আমি আর কারো স্পর্শ চাই না…
তুই আমায় দাগ দিয়ে রাখ, রুদ্র…”
তার ঠোঁট আবার ইশার বুকে, পিঠে, কোমরের নিচে,
ইশার শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল –
কিন্তু এই কাঁপুনি ছিল শান্তির, ভালোবাসার, আর সম্পূর্ণরূপে নিজেকে কারো হাতে ছেড়ে দেওয়ার।
---
📍 গভীর রাত
তারা দুজন পাশাপাশি শুয়ে।
রুদ্র বলল,
– “তুই জানিস, ইশা, আমি তোর জন্য আমার নিজেকে হারাতে পারি।”
– “তুই হারাস… তোর মাঝেই আমি নিজেকে খুঁজে পাই।”
হঠাৎই ইশা উঠে বসে।
– “তুই বল তো রুদ্র… যদি কাল সায়ন আবার আসে, আমি কি তখনও এতটাই শক্ত থাকব?”
– “না। কারণ আমি তোকে এতটাই নিজের করে ফেলব,
তুই আর কারো ডাক শুনতেই পাবি না।”
রুদ্রর কথায় ছিল আগুন…
আর সেই আগুনেই ইশা আরেকবার গলে যায়।
“যাকে ছেড়েছিলি, সে এখন নিজের আগুনে জ্বলছে…”
📍 সকালে ইশা ঘুম ভাঙতেই দেখে রুদ্র পাশে নেই।
সে উঠে বসে। পুরো ঘর নিঃস্তব্ধ।
চোখে অদ্ভুত একটা অস্বস্তি।
হঠাৎ রান্নাঘর থেকে আওয়াজ আসে।
সে দৌড়ে যায় —
রুদ্র কফি বানাচ্ছিল। চোখে ঘুম নেই, মুখে অদ্ভুত একটা চাপা অভিমান।
– “তুই এত সকালে উঠে পড়লি?”
– “ঘুম আসে না। তুই এখন আমার, তাও কেন জানি ভয় লাগে…”
ইশা এসে ওর হাত ধরে।
– “রুদ্র… আমি তো তোকে বলে দিয়েছি, আমি ফিরে এসেছি।
তুই বিশ্বাস করবি না?”
রুদ্র চুপ করে।
– “বিশ্বাস করি।
কিন্তু ভয় পাই, যদি কাল আবার কেউ তোকে ডাকে…
তুই কী করবি?”
ইশা এবার রেগে যায়।
– “তুই যদি আমাকে এতটাই সন্দেহ করিস, তাহলে ভালোবাসিস কিসে?”
– “ভালোবাসি বলেই তো কষ্ট পাই!”
এই বাক্যটা দুইজনের মাঝখানে দেয়াল তৈরি করে।
---
📍 বিকেল – হঠাৎ একটা চিঠি আসে
ইশার নামে একটা চিঠি।
কোনো প্রেরকের নাম নেই।
ইশা খুলে দেখে —
সায়নের হাতে লেখা চিঠি:
> "তুই গেছিস, এটা মেনে নিয়েছি।
কিন্তু আমি জানি, তোর চোখে আজও একটা প্রশ্ন বেঁচে আছে –
আমি যদি তোর পাশে থাকতাম, আজ তোর জীবন অন্যরকম হতো কি না।
আমি আবার ফিরছি, ইশা…
আমি আবার চাই, তুই আমাকে একবার দেখে বুঝিস, তোর রুদ্র কি সত্যিই তোকে ধরে রাখতে পারবে?"
ইশা হতবাক।
সে বুঝে যায় –
এই প্রেম এখন আর শুধুই প্রেম নেই।
এটা এখন মনের লড়াই, স্পর্শের দখল, এবং এক দগ্ধ অতীতের প্রতিশোধ।
---
📍 রাত
রুদ্র চুপচাপ বিছানায় বসে।
ইশা ওর পাশে গিয়ে বসে।
– “সায়ন ফিরে আসছে।”
– “জানি।”
– “তুই কী করবি?”
রুদ্র উঠে দাঁড়ায়।
তার চোখে এবার আগুন নয় – বরফ।
– “তুই যদি তোর পুরনো ছায়া ধরে রাখতে চাস, আমি সরে যাব।
কিন্তু যদি আমার হতে চাস, তাহলে এবার সব বন্ধ দরজা বন্ধ করেই আসিস।”
ইশার চোখে জল এসে যায়।
– “তুই কী চাস আমি কী করি?”
– “আমি কিছু চাই না।
আমি শুধু দেখতে চাই – তুই কাকে আগুনে পোড়াতে চাস…
তোর অতীতকে? নাকি আমায়?”
---
📍 শেষ দৃশ্য
ইশা একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে।
আকাশে চাঁদ।
হাওয়া বইছে।
সে নিজেকেই প্রশ্ন করছে:
– “আমি কাকে বেশি ভালোবাসি?
যে আমাকে ভালোবেসে আগুনে রেখেছে?
নাকি যে আমাকে আগুন বানিয়ে ভালোবাসতে শিখিয়েছে?”
হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে।
সায়নের নাম।
সে তাকিয়ে থাকে স্ক্রিনের দিকে…
📞 ফোনটা ধরে না।
পেছনে রুদ্র এসে দাঁড়ায়।
কিছু বলে না।
তারা দুজন কেবল চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে…
আগুনের ছোঁয়ায় পুড়তে থাকা এক ভালোবাসার সন্ধিক্ষণে।
---
> "ভালোবাসা এক আগুন, আর আগুন কখনও নিরব হয় না—
সে হয় জ্বলে, না হয় ভস্ম করে দেয় সবকিছু…"
---