You can. - 3 in Bengali Motivational Stories by SAKTI BISWAS books and stories PDF | তুমি পারবে - 3

Featured Books
Categories
Share

তুমি পারবে - 3

অধ্যায় - ৩ 


                         ব্যর্থতা মানেই শেষ নয়

শহরের এক প্রান্তে একটি ছোট্ট পাড়া। সেখানেই জন্ম অরিন্দমের। বাবা একজন স্কুলশিক্ষক, মা গৃহিণী। পরিবারে অত ধন-সম্পদ নেই, তবে শিক্ষার পরিবেশ ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। ছোটবেলা থেকেই অরিন্দম পড়াশোনায় ভালো ছিল, কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল অন্য কিছু—একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়া।
কলেজে উঠেই সে ঠিক করেছিল, সে ব্যবসা করবে। বন্ধুদের মতো চাকরির পিছনে ছুটবে না। এই স্বপ্ন নিয়েই সে নানা রকম ছোটখাটো উদ্যোগ শুরু করল। প্রথমে অনলাইন বই বিক্রির ব্যবসা, পরে হ্যান্ডমেড সামগ্রীর দোকান। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থতা তার পথ আটকে দিল।
প্রথমবারের ব্যর্থতায় তার বুক কেঁপে উঠেছিল। অনলাইন বই বিক্রির প্ল্যাটফর্ম বানাতে গিয়ে প্রায় তিন মাস দিনরাত পরিশ্রম করেছিল। কিন্তু মার্কেটিং ঠিকমতো জানত না বলে ব্যবসা দাঁড়াতেই পারল না। তার সমস্ত মূলধন শেষ হয়ে গেল। সেই সময় পরিবারও খুব নিরাশ হয়েছিল। বাবা বলেছিলেন—
“চাকরি করাই ভালো ছিল রে, এইসব ফালতু স্বপ্ন দেখিস না।”
কিন্তু অরিন্দমের ভেতরে অন্যরকম জেদ। সে ভাবল, না, এত সহজে থামা যাবে না। আবার চেষ্টা শুরু করল। এবার হ্যান্ডমেড সামগ্রীর দোকান। প্রথম কয়েক মাস ব্যবসা বেশ ভালো চলল। অর্ডার আসছিল, গ্রাহকও খুশি। অরিন্দম ভেবেছিল, এবার বোধহয় স্বপ্ন পূরণ হবে। কিন্তু হঠাৎ বাজারে বড় প্রতিযোগীরা নেমে পড়ল। দাম কমিয়ে এমন অফার দিল যে অরিন্দমের ব্যবসা টিকল না। তার দোকান বন্ধ হয়ে গেল।
এই ব্যর্থতায় সে ভীষণ ভেঙে পড়েছিল। বন্ধুরা তখন চাকরি করে মাসিক বেতন পাচ্ছে, আর সে বসে আছে খালি হাতে। আত্মীয়-স্বজন সবাই তাকে ব্যর্থ বলে হাসাহাসি করত। অনেকে বলত—
“ওর দিয়ে কিছু হবে না। এতবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হল, এবার আর কিছু হবে না।”
অরিন্দম ভেতরে ভেতরে দমে যাচ্ছিল। একদিন গভীর রাতে ছাদে বসে সে ভাবছিল—
“হয়তো আমি ভুল করছি। হয়তো বাবা ঠিকই বলছে। হয়তো আমার দিয়ে ব্যবসা হবে না।”
ঠিক তখনই সে মনে পড়ল, একসময় সে একটা বই পড়েছিল—“সাফল্যের পথ।” বইটাতে লেখা ছিল, “ব্যর্থতা কখনোই শেষ নয়, ব্যর্থতা আসলে নতুনভাবে শেখার সুযোগ।” এই লাইনটা তার মাথায় যেন বাজতে লাগল। সে ভেবেছিল, প্রতিবারই সে হেরে যাচ্ছে, কিন্তু প্রতিবারই তো নতুন কিছু শিখছে। প্রথমবার শিখেছিল মার্কেটিং কত জরুরি। দ্বিতীয়বার শিখেছিল প্রতিযোগিতার জন্য আলাদা কৌশল থাকা দরকার।
সেই রাতে অরিন্দম একটা সিদ্ধান্ত নিল—সে এবার সত্যিই শেষবার চেষ্টা করবে। তবে এবার অন্ধভাবে নয়, পরিকল্পনা করে।
সে আবার পড়াশোনা শুরু করল। ব্যবসা নিয়ে বই পড়তে লাগল, সফল উদ্যোক্তাদের সাক্ষাৎকার দেখতে লাগল, মার্কেটিং, ফিন্যান্স, কাস্টমার কেয়ার—সব কিছু খুঁটিয়ে শিখতে লাগল। দিন-রাত পরিশ্রম করল নিজের জ্ঞান বাড়ানোর জন্য।
কয়েক মাস পর অরিন্দম একটি নতুন আইডিয়া পেল—গ্রামের কৃষকদের সাথে সরাসরি শহরের ক্রেতাদের সংযোগ করানো। কারণ সে দেখল, গ্রামে কৃষক ন্যায্য দাম পায় না, আর শহরে মানুষ বেশি দামে সবজি-ফল কিনতে বাধ্য হয়। যদি এই দুই পক্ষকে সরাসরি যুক্ত করা যায়, তাহলে দু’দিকের মানুষই উপকৃত হবে।
অরিন্দম এবার ছোট করে শুরু করল। প্রথমে কয়েকজন কৃষককে রাজি করাল, তাদের কাছ থেকে সবজি এনে শহরে বিক্রি করতে লাগল। দামও ন্যায্য রাখল। ক্রেতারা খুশি, কৃষকরাও খুশি। অল্পদিনেই খবর ছড়িয়ে পড়ল।
শুরুতে অনেক সমস্যাই এসেছিল। পরিবহন সমস্যা, কৃষকদের বিশ্বাস করানো, ক্রেতাদের আস্থা অর্জন—সবই কঠিন ছিল। কিন্তু প্রতিবার ব্যর্থতার থেকে শেখা অভিজ্ঞতা এবার তাকে দমাতে পারল না। ধীরে ধীরে সে ব্যবস্থা ঠিক করতে লাগল।
এক বছরের মধ্যেই তার এই ছোট্ট উদ্যোগ বড় রূপ নিল। সে একটি মোবাইল অ্যাপ বানাল, যেখানে কৃষকরা সরাসরি তাদের পণ্য তালিকাভুক্ত করতে পারে, আর শহরের মানুষ অর্ডার করতে পারে। তার ব্যবসা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠল।
আজ অরিন্দম শুধু একজন সফল উদ্যোক্তাই নয়, সে অনেক কৃষকের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। তার বাবা-মা, যারা একসময় তার উপর ভরসা হারিয়ে ফেলেছিলেন, আজ গর্বে বুক ভরে বলে।
“ও আমাদের ছেলে, আমাদের স্বপ্ন।”
অরিন্দম জানে, যদি সে প্রথম দুইবার ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিত, তবে আজকের এই অবস্থায় আসতে পারত না। সে বুঝে গেছে
ব্যর্থতা আসলে শেষ নয়, বরং নতুন সূচনা। ব্যর্থতা মানেই শেখা, আর শেখা মানেই সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া।


ব্যর্থতা মানেই শেষ নয় (বর্ধিত অংশ)

অরিন্দমের জীবনের প্রথম দিকটা মোটেও সহজ ছিল না। ছোটবেলায় সে ক্লাসে সবসময় প্রথম হতেও পারত না, আবার একেবারেই পিছিয়েও যেত না। সে ছিল মাঝামাঝি মানের ছাত্র। কিন্তু এক জিনিস তার মধ্যে ছোটবেলা থেকেই ছিল—নতুন কিছু ভাবার প্রবণতা। স্কুলে পড়ার সময় যখন অন্যরা শুধু পরীক্ষার নম্বরের দিকে মন দিত, অরিন্দম তখন ভাবত—
“কেন আমরা সবকিছু শুধু মুখস্থ করি? যদি আমি একদিন নিজের কিছু বানাতে পারি?”
বন্ধুরা তখন হাসত। বলত—
“তুই আবার বড় হয়ে কী করবি? চাকরি ছাড়া আর কিছু হয় নাকি?”
এই ধরনের কথা তাকে ছোটবেলা থেকেই খোঁচা দিত। তবুও সে চুপচাপ স্বপ্ন বুনত নিজের ভেতরে।

প্রথম বড় ব্যর্থতা

কলেজে ওঠার পরই সে তার প্রথম উদ্যোগ শুরু করল। বন্ধুদের সঙ্গে মিলে একটা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম খুলল—যেখানে পুরোনো বই কেনা-বেচা হবে। আইডিয়াটা শুনতে ভালো ছিল। সবাই ভেবেছিল দারুণ চলবে। কিন্তু বাস্তবে কয়েকটা ভুল ছিল
১. সঠিক প্রচারণা হয়নি।
২. অনলাইনে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে পারেনি।
৩. আর্থিক পরিকল্পনা ছিল দুর্বল।
ফলাফল, কয়েক মাসের মধ্যেই ব্যবসা ধপাস করে ভেঙে পড়ল।
এই ব্যর্থতার পর সে কয়েকদিন একেবারেই নিজের ঘরে বন্ধ হয়ে ছিল। বন্ধুরা ফোন করত, মেসেজ দিত, কিন্তু সে আর উত্তর দিত না। তার মনে হত—সব শেষ হয়ে গেছে।
একদিন মা এসে বললেন—
“অরিন্দম, হেরে গেলে কি চলবে? তুমি তো এখনো চেষ্টা করনি শেষবারের মতো।”
মায়ের চোখের সেই বিশ্বাসী দৃষ্টি তাকে আবার টেনে তুলেছিল।

দ্বিতীয় ব্যর্থতা – দোকানের ভাঙন

হ্যান্ডমেড সামগ্রীর দোকান ছিল তার দ্বিতীয় উদ্যোগ। শুরুর দিকে অনেক উৎসাহ নিয়ে কাজ শুরু করেছিল। এমনকি প্রথম ক’টা মাস দারুণ লাভও হচ্ছিল। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি বড় কোম্পানিগুলো কেমন দ্রুত বাজার দখল করে নেয়। তারা এত কম দামে পণ্য নামাল যে অরিন্দমের দোকান টিকতে পারল না।
এই ব্যর্থতার পর চারদিক থেকে একটাই কথা আসতে লাগল
“তুই ব্যর্থ। তোর দিয়ে কিছু হবে না।”
বন্ধুরা তখন অফিসে ভালো বেতন পাচ্ছে, কেউ বিদেশে পড়াশোনা করতে চলে গেছে। আর অরিন্দম বসে আছে খালি হাতে।
এই সময়েই তার জীবনে এল এক অদ্ভুত রাত।
ছাদে একাকী রাত
গভীর রাতে ছাদে বসে অরিন্দম আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল—
“আমি কি সত্যিই ভুল করছি? বাবা হয়তো ঠিকই বলেছে। আমার জন্য হয়তো চাকরিই ভালো।”
তারপরই মাথায় ভেসে উঠল সেই লাইন—
“ব্যর্থতা মানেই শেষ নয়।”
এই লাইনটাই যেন তার জীবন বদলে দিল।
সে সিদ্ধান্ত নিল, এবার শেষবার চেষ্টা করবে। তবে এবার অন্ধভাবে নয়, প্রস্তুতি নিয়ে।

শেখার সময়

অরিন্দম বই পড়তে শুরু করল—ব্যবসা, অর্থনীতি, মার্কেটিং। সফল উদ্যোক্তাদের গল্প শুনল, তাদের ব্যর্থতা থেকে শেখা নিল। প্রতিদিন রাতে সে নিজের খাতায় লিখে রাখত—আজ কী শিখলাম, কোথায় ব্যবহার করতে পারব।
এই শেখার মধ্যেই তার মাথায় এল নতুন চিন্তা—কৃষক ও শহরের ক্রেতাদের সংযোগ করানো।

শুরুটা কঠিন ছিল

প্রথমে গ্রামের কৃষকরা বিশ্বাসই করল না। তারা ভাবল—
“একজন শহরের ছেলে এসে বলে যাবে আমাদের সবজি শহরে বিক্রি করবে? এটা কি এত সহজ?”
অরিন্দমকে বারবার ফিরিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু সে হাল ছাড়ল না। প্রতিদিন সাইকেল নিয়ে গ্রামে যেত, কৃষকদের সঙ্গে বসত, তাদের সমস্যার কথা শুনত। ধীরে ধীরে কয়েকজন কৃষক রাজি হল।
সে সবজি শহরে এনে বিক্রি করতে শুরু করল। দামও রাখল সঠিক। শহরের মানুষ খুশি, কৃষকেরাও লাভ পেল।
কিন্তু এখানেও সমস্যা এল। পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছিল, অনেক সময় সবজি পচে যেত, গ্রাহকরা অভিযোগ করত।
তখনই অরিন্দম তার পুরোনো ব্যর্থতাগুলো মনে করে সমাধান বের করল—
মার্কেটিং কৌশল ব্যবহার করল।
একটি ছোট্ট গুদামঘর বানাল।
সময়মতো ডেলিভারির জন্য স্থানীয় কিছু ছেলেকে কাজে লাগাল।


প্রথম সাফল্যের স্বাদ

প্রায় এক বছরের মাথায় ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে গেল। এবার সে একটি অ্যাপ চালু করল। কৃষকেরা নিজেদের পণ্য তালিকাভুক্ত করতে পারল, আর শহরের মানুষ সরাসরি অর্ডার দিতে পারল।
অল্পদিনের মধ্যেই অ্যাপটি জনপ্রিয় হয়ে উঠল। লোকজন বলত—
“এই ছেলেটার জন্য আমরা এখন ভালো দামে তাজা সবজি পাচ্ছি।”

সমাজের পরিবর্তিত দৃষ্টি

যারা আগে অরিন্দমকে ব্যর্থ বলত, তারাই এখন তাকে দেখে অবাক হয়। বন্ধুরা এসে বলত—
“তুই সত্যিই দারুণ কাজ করেছিস। আমরা চাকরিতে আটকে আছি, কিন্তু তুই নিজের একটা সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিস।”
অরিন্দম তখন মুচকি হেসে বলত—
“আমি শুধু হাল ছাড়িনি। ব্যর্থতা আমাকে শিখিয়েছে।”

পরিবারের গর্ব

সবচেয়ে বড় গর্বের মুহূর্ত এল যখন তার বাবা স্কুলে এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। সবাই অরিন্দমের কথা বলছিল। তখন তার বাবা বলেছিলেন—
“হ্যাঁ, অরিন্দম আমার ছেলে। একসময় আমি ওকে ভুল বুঝেছিলাম, কিন্তু আজ ও-ই আমাদের পরিবারের সবচেয়ে বড় শক্তি।”
বাবার মুখে এই স্বীকৃতি পেয়ে অরিন্দমের চোখে জল চলে এসেছিল।

ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা

আজ অরিন্দম শুধু নিজের স্বপ্ন পূরণ করেনি, বরং শত শত কৃষকের জীবন বদলে দিয়েছে। তার ব্যবসা শুধু লাভের জন্য নয়, সমাজের জন্যও উপকারী।
সে জানে, আগামী দিনেও অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে। কিন্তু এখন সে নির্ভীক। কারণ সে শিখে গেছে—
ব্যর্থতা কখনোই শেষ নয়, বরং প্রতিটি ব্যর্থতাই সাফল্যের দিকে একেকটা সিঁড়ি।