মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৬৩
অষ্টাদশ দিনের যুদ্ধের শেষে দুর্যোধনের হ্রদে প্রবেশ
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
অষ্টাদশ দিনের যুদ্ধের শেষে দুর্যোধনের হ্রদে প্রবেশ
বাকি বেঁচে থাকা কৌরবসৈন্য দুর্যোধনের বাক্যে উৎসাহিত হয়ে আবার যুদ্ধে রত হোলো কিন্তু পাণ্ডবসৈন্যের আক্রমণে তারা সকলে নিহত হয়ে গেল। দুর্যোধনের একাদশ অক্ষৌহিণী সেনা ধ্বংস হোলো। পাণ্ডবসেনার দুই হাজার রথ, সাত শত হাতি, পাঁচ হাজার ঘোড়া ও দশ হাজার পদাতিক অবশিষ্ট রইল। দুর্যোধন যখন দেখলেন যে তার সহায় কেউ নেই তখন তিনি একাকী গদা হাতে নিয়ে দ্রুতবেগে পূর্বদিকে প্রস্থান করলেন।
সঞ্জয়কে দেখে ধৃষ্টদ্যুম্ন সহাস্যে সাত্যকিকে বললেন, একে বন্দী কোরে কি হবে, এর জীবনে কোনও প্রয়োজন নেই। সাত্যকি তখন খড়্গ তুলে সঞ্জয়কে বধ করতে উদ্যত হলেন। সেই সময়ে মহাপ্রাজ্ঞ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস উপস্থিত হয়ে বললেন, সঞ্জয়কে মুক্তি দাও, একে বধ করা কখনও উচিত নয়। সাত্যকি কৃতাঞ্জলি হয়ে বেদব্যাসের আদেশ মেনে নিয়ে বললেন, সঞ্জয়, যাও, তোমার মঙ্গল হোক। বর্মহীন ও নিরস্ত্র সঞ্জয় মুক্তি পেয়ে সন্ধ্যায় রক্তাক্তদেহে হস্তিনাপুরের দিকে প্রস্থান করলেন।
রণস্থল থেকে এক ক্রোশ দূরে গিয়ে সঞ্জয় দেখলেন, দুর্যোধন ক্ষত-বিক্ষতদেহে গদা হাতে নিয়ে একাকী রয়েছেন। দুজনে কাতরভাবে কিছুক্ষণ পরস্পরের দিকে চেয়ে রইলেন, তারপর সঞ্জয় তার বন্ধন ও মুক্তির বিষয় জানালেন। ক্ষণকাল পরে দুর্যোধন প্রকৃতিস্থ হয়ে তার ভাইদের ও সৈন্যদের বিষয় জিজ্ঞাসা করলেন। সঞ্জয় বললেন, আপনার সকল ভাই নিহত হয়েছেন, সৈন্যও নষ্ট হয়েছে, কেবল কৃপ, অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা বেঁচে আছেন। প্রস্থানকালে বেদব্যাস আমাকে এই কথা বলেছেন। দুর্যোধন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সঞ্জয়কে স্পর্শ কোরে বললেন, এই যুদ্ধে আমার পক্ষে তুমি ভিন্ন দ্বিতীয় কেউ জীবিত নেই, কিন্তু পাণ্ডবরা সহায়সম্পন্নই রয়েছে। সঞ্জয়, তুমি প্রজ্ঞাচক্ষু রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে বলবে, আপনার পুত্র দুর্যোধন দ্বৈপায়ন হ্রদে আশ্রয় নিয়েছে। আমার ভাই ও পুত্রেরা নিহত হয়েছে, রাজ্য পাণ্ডবরা নিয়েছে, এ অবস্থায় কে বেঁচে থাকে? তুমি আরও বলবে, আমি মহাযুদ্ধ থেকে মুক্ত হয়ে ক্ষতবিক্ষতদেহে এই হ্রদে নিদ্রিতের ন্যায় নিশ্চেষ্ট হয়ে জীবিত রয়েছি।
এই কথা বলে রাজা দুর্যোধন দ্বৈপায়ন হ্রদের মধ্যে প্রবেশ করলেন এবং মায়া দ্বারা তার জল স্তম্ভিত করে রইলেন। এই সময়ে কৃপাচার্য অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা রথে চড়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। সঞ্জয় সকল সংবাদ জানালে অশ্বত্থামা বললেন, হা ধিক, রাজা দুর্যোধন জানেন না যে আমরা জীবিত আছি এবং তার সঙ্গে মিলিত হয়ে শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করতেও সমর্থ আছি। সেই তিন মহারথ বহুক্ষণ বিলাপ করলেন, তার পর পাণ্ডবদের দেখতে পেয়ে বেগে শিবিরে চলে গেলেন।
সূর্যাস্ত হলে কৌরবশিবিরের সকলেই দুর্যোধনের ভাইদের বিনাশের সংবাদ পেয়ে অত্যন্ত ভীত হোলো। দুর্যোধনের অমাত্যগণ এবং নারীরক্ষকগণ রাজমহিষীদের নিয়ে হস্তিনাপুরে যাত্রা করলেন। শয্যাদিও পাঠানো হোলো। অন্যান্য সকলে রথে চড়ে নিজ নিজ পত্নীসহ প্রস্থান করলেন। পূর্বে রাজপুরীতে যারা সূর্যও দেখতে পেতেন না, তাদের এখন সকলেই দেখতে লাগলো।
বৈশ্যাগৰ্ভজাত ধৃতরাষ্ট্রপুত্র যুযুৎসু যিনি পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়েছিলেন, তিনিও যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে রাজমহিষীদের সঙ্গে প্রস্থান করলেন। হস্তিনাপুরে এসে যুযুৎসু বিদুরকে সকল বৃত্তান্ত জানালেন। বিদুর বললেন, বৎস, কৌরবকুলের এই ক্ষয়কালে তুমি এখানে এসে উপযুক্ত কাজই করেছ। হতভাগ্য অন্ধ রাজার তুমিই এখন একমাত্র অবলম্বন। আজ বিশ্রাম কোরে কাল তুমি যুধিষ্ঠিরের কাছে ফিরে যেয়ো।
______________
(ক্রমশ)