Story of Mahabharat Part 98 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 98

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 98

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৯৮

কৃষ্ণ এবং কর্ণের মধ্যে কথপোকথনের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

কৃষ্ণ এবং কর্ণের মধ্যে কথপোকথনের কাহিনি

কুন্তীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কর্ণকে নিজের রথে তুলে নিয়ে যেতে যেতে কৃষ্ণ কর্ণকে বললেন, তুমি বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের সেবা করেছ এবং তাদের কাছে ধর্মশাস্ত্রের সূক্ষ্ম সমস্ত তত্ত্ব শিখেছ। কুমারী কন্যার গর্ভে দুই প্রকার পুত্র হয়, কানীন ও সহোঢ়। শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতগণ বলেন, এই রকম কন্যাকে যে বিবাহ করে সেই লোকই এই দুইপ্রকার পুত্রের পিতা। কর্ণ, তুমি কানীন পুত্র এবং ধর্ম অনুসারে পাণ্ডুরই পুত্র। অতএব তুমিই রাজা হও, তোমার পিতৃপক্ষীয় পাণ্ডবগণ এবং মাতৃপক্ষীয় বৃষ্ণিগণ দুই পক্ষকেই তোমার সহযোগি বলে জেনো। তুমি আজ আমার সঙ্গে চলো, পাণ্ডবরা জানুন যে তুমি যুধিষ্ঠিরের অগ্রজ। তোমার পাঁচ ভাই, দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র এবং অভিমন্যু তোমাকে সাদরে বরণ করবেন, সমাগত রাজারা এবং অন্ধক ও বৃষ্ণিবংশীয় সকলেই তোমার অনুসারী হবেন। রাজা ও রাজকন্যারা তোমার অভিষেকের জন্য সোনা, রূপো ও মাটির কলস এবং বিভিন্ন ওষধি বীজ, রত্ন প্রভৃতি উপকরণ নিয়ে আসবেন, দ্রৌপদীও ষষ্ঠ কালে তোমার সঙ্গে মিলিত হবেন। আমরা তোমাকে পৃথিবীর রাজপদে অভিষিক্ত করবো, যুধিষ্ঠির যুবরাজ হবেন এবং শুভ্র চামর হাতে তোমার পিছনে থাকবেন। ভীম তোমার মাথার উপর শুভ্র ছাতা ধরবেন, অর্জুন তোমার রথ চালাবেন, অভিমন্যু সব সময় তেমার কাছে থাকবেন। নকুল, সহদেব, দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র, পাঞ্চালগণ ও মহারথ শিখণ্ডী তোমার অনুগমন করবেন। কুন্তীপুত্র, তুমি ভাইদের সঙ্গে নিয়ে রাজ্যশাসন করো, কুন্তী ও মিত্রগণ আনন্দিত হন, পাণ্ডব ভাইদের সঙ্গে তোমার সুসম্পর্ক হোক।

কর্ণ বললেন, কৃষ্ণ, তুমি যা বললে তা আমি জানি, ধর্মশাস্ত্র অনুসারে আমি পাণ্ডুরই পুত্র। কুন্তী কন্যা অবস্থায় সূর্যের ঔরসে আমাকে গর্ভে ধারণ করেন এবং হিতাহিত চিন্তা না করে আমাকে ত্যাগ করেন। সূতবংশীয় অধিরথ আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে এলে স্নেহবশে তখনই তার স্ত্রী রাধার স্তনদুগ্ধ নির্গত হয়েছিল, তিনি নিজে আমার মলমূত্রও পরিস্কার করেছিলেন। আমি কি করে তাদের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারি? অধিরথ আমাকে পুত্র মনে করেন, আমিও তাকে পিতা মনে করি।

তিনি আমার কৌলিক প্রথা অনুযায়ী জাতকর্মাদি করিয়েছেন, তার নিযুক্ত ব্রাহ্মণরা আমাকে বসুষেণ নাম দিয়েছেন, তার আশ্রয়েই যৌবনলাভ করে আমি বিবাহ করেছি। স্ত্রীদের সঙ্গে আমার প্রেমের গভীর প্রেমের সম্পর্ক আছে, তাদের গর্ভে আমার পুত্র-কন্যাও হয়েছে। কৃষ্ণ, সমস্ত পৃথিবী এবং রাশি রাশি সোনা পেলেও আমি সেই সম্পর্ক অস্বীকার করতে পারি না, সুখের লোভে বা ভয় পেয়েও নয়। আমি দুর্যোধনের আশ্রয়ে তেরো বছর নিশ্চিন্তে রাজ্য ভোগ করেছি। সুতগণের সঙ্গে আমি বহু যজ্ঞ করেছি, তাদের সঙ্গে আমার বৈবাহিক সম্পর্কও আছে। আমার ভরসাতেই দুর্যোধন যুদ্ধের উদ্যোগ করেছেন, দ্বৈরথ যুদ্ধে অর্জুনের প্রতিযোদ্ধা রূপে আমাকেই বরণ করেছেন। মৃত্যু বা বন্ধনের ভয়ে অথবা লোভের বশে আমি তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না। তুমি যা বললে তা অবশ্য হিতের জন্যই। তুমি আমাদের এই আলোচনা গোপনে রেখো, ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির যদি জানতে পারেন যে আমিই কুন্তীর প্রথম পুত্র তবে আর তিনি রাজ্য নেবেন না। যদি আমিই সেই রাজ্য পাই তবে দুর্যোধনকেই সমর্পণ করবো। অতএব যুধিষ্ঠিরই রাজ্য লাভ করুন, কৃষ্ণ তাঁর নেতা এবং অর্জুন তাঁর যোদ্ধা হয়ে থাকুন। ত্রিলোকের মধ্যে পুণ্যতম স্থান কুরুক্ষেত্রে বিশাল ক্ষত্রিয়মণ্ডল যেন যুদ্ধেই নিহত হন, সমস্ত ক্ষত্রিয়ই যেন স্বর্গলাভ করেন। মৃদু হেসে কৃষ্ণ বললেন, কর্ণ, আমি তোমাকে সমগ্র পৃথিবীর রাজা করতে চাই, কিন্তু তুমি তা নেবে না। পাণ্ডবদের জয় হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তুমি ফিরে গিয়ে ভীষ্ম দ্রোণ ও কৃপকে বলো, এখন অতি শুভকাল, এখন পশুখাদ্য সুলভ, শস্য পরিপুষ্ট, সকল গাছ ফলবান, পথে কাদা নেই, জল সুস্বাদু হয়েছে, শীত বা গ্রীষ্ম কিছুই অধিক নয়। সাত দিন পরে অমাবস্যা, সেই দিন যুদ্ধ আরম্ভ হোক। যুদ্ধের জন্য সমাগত রাজাদের বলো যে তাদের ইচ্ছা পূর্ণ হবে, দুর্যোধনের অনুগামী রাজা ও রাজপুত্রগণ অস্ত্রাঘাতে নিহত হয়ে উত্তম গতি লাভ করবেন।

কর্ণ কৃষ্ণকে বললেন, সব জেনেও কেন আমাকে ভোলাতে চাইছ? এই পৃথিবীর ধ্বংস আসন্ন, দুর্যোধন দুঃশাসন শকুনি আর আমি তার নিমিত্তস্বরূপ। আমি দারুণ স্বপ্ন ও দুর্লক্ষণ দেখেছি, তুমি যেন রক্তে ভেজা পৃথিবীকে হাতে ধরে নিক্ষেপ করছ, পর্বত প্রমাণ মানুষের হাড়ের উপরে বসে যুধিষ্ঠির যেন সোনার পাত্রে ঘীয়ের পায়স ভোজন করছেন এবং তোমার দেওয়া পৃথিবী গ্রাস করছেন। কৃষ্ণ বললেন, আমার কথা যখন তোমার হৃদয়ে প্রবেশ করলো না তখন অবশ্যই পৃথিবীর বিনাশ হবে। কর্ণ বললেন, কৃষ্ণ, এই মহাযুদ্ধের শেষে আমরা কি আবার তোমাকে দেখতে পাবো? অথবা স্বর্গেই আমাদের মিলন হবে? এখন আমি যাচ্ছি। এই বলে কর্ণ কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে রথ থেকে নামলেন এবং নিজের রথে উঠে বিষণ্ণ মনে চলে গেলেন।

______________

(ক্রমশ)