Jharapata - 8 in Bengali Love Stories by Srabanti Ghosh books and stories PDF | ঝরাপাতা - 8

Featured Books
Categories
Share

ঝরাপাতা - 8

ঝরাপাতা

পর্ব - ৮

🏜🌿🏜🌿🏜🌿🏜

মিলি কথাই বলতে চায় না। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ, মনোজের ইশারায় মা, মাসি, মামী আলাদা করে নিয়ে গিয়েও দেখে মিলি যেন জমাট বরফ হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে জানা যায়, ওর সঙ্গে কেউ কথাবার্তা বলেনি, পিউ দরকারে দু চারটে কথা বলেছে। রনি কি বলেছে জানতে চাইলেও এক উত্তর, কোনো কথা বলেনি। 

সম্পর্কের দিক ভুলে ওর মামী সরাসরি প্রশ্ন করে বসে, গতকাল রাতে রনি কি বলেছে। মিলির থেকেই সবাই সবচেয়ে শকিং খবরটা শোনে, রাত থেকেই রনি বেপাত্তা। মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিল ওরা। গোপার বোন তপতীর ছেলে মনসিজ এসে মাকে ডাকাডাকি করে, ওর খিদে পেয়েছে। সকলেরই হুঁশ ফিরে আসে, খেতে হবে, বাঁচতে হবে, লড়াই করতে হবে রনি আর ওর বাড়ির বিরুদ্ধে। 

গোপা এসে সমরকে সব কথা বলে যোগ করে, "আমি ওদের নামে কেস করব।"

হাঁ হাঁ করে ওঠে অমর আর মনোজ। এক্ষুণি এক্ষুণি কেস করে কিছু হবে না। ঝানু উকিল প্রমাণ করে দেবে বিয়ের কনে পালানোয় রনি আপসেট ছিল। তবে মিলিকে কোনো অসুবিধা দেওয়া হয়নি। সে সেফ ছিল, বাড়ির সকলের কাছে যত্নে ছিল। এখনও মিলিকে পাঠানো হয়েছে সমরকে দেখতে এবং পরে ফিরিয়ে নেবে বলেও দিয়েছে মণিকা। 

তাই কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখতে হবে, ওরা কি করে না করে। যদি মিলির খোঁজ খবর রাখে, কিছুদিন পর রনি ফিরে আসে, তাহলে একরকম। কারণ রনি হয়তো সত্যিই আপসেট, এটাও ঠিক কথা। 

কিন্তু যদি দেখা যায়, রনি আপাততঃ ফিরলই না, কোথাও ঘাপটি মেরে বসে থাকল, রনির খবর এ বাড়িতে জানানো হল না, মিলিকেও ওরা কোনো অধিকার, কোনো মর্যাদা দিচ্ছে না, সেক্ষেত্রে ভাল উকিল, ব্যারিস্টারের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। 

মোটকথা, এপাশ ওপাশের কানাগলিগুলো খতিয়ে না দেখেই, সোজা পথে সব চলবে ধরে নিয়ে, দু দুবার বিয়ের কথায় এগোনোর পর, এবার বোধহয় ধাক্কাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে সবাই অপেক্ষা করাই বেছে নেয়। 

তবে আশেপাশের লোকজন অপেক্ষা করতে নারাজ। একেই কাহিনীর শুরু বেশ মুখরোচক ঘটনায়, অথচ সবাই খবর পাওয়ার আগেই লিলির বদলি কনে হিসেবে মিলিকে বাছাই করা হয়ে গেছিল। ফলে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে সবার নজর এই দু বাড়িতেই আটকে আছে। মিলিকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনাটা বেশ চাউর হয়ে গেছে। বাড়ির সদস্যরা স্কুল, কলেজ, অফিসে রওনা হতেই যারা সারাদিন বাড়িতে থাকেন, সেই মহিলারা সবাই একা বা দু তিন জনের দল এবাড়ি ওবাড়ি হানা দেয়। 

ও বাড়িতে মণিকা দূরে থাক, পিউও নিচে আসে না। আত্মীয় স্বজনরা এই প্রতিবেশীদের সব কৌতূহল অল্প কথায় মিটিয়ে দেয়, বাড়ির কারও শরীর ভাল না, ছেলেরা ব্যস্ত, মিলি গেছে বাবাকে দেখতে। আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি নেই, আসুন বসুন মিষ্টি খেয়ে যান, যথারীতি বলা হয়। পেটের খবরই যদি না পাওয়া যায়, মিষ্টিমুখে কাজ কি? যারা মিলির বাড়ি প্রথম গেছিল, তারা জাঁকিয়ে বসে খুঁটিনাটি প্রশ্ন করে, রনির বাড়ি যারা গেছিল তারাও ওখানে ঘুরে এবাড়িতেই আসর জাঁকিয়ে বসে। 

প্রতিবেশীদের কাউকে কখনও কড়া কথা বলা যায় না, সে যতই একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ের উপর প্রশ্ন হোক। আর এখন তো দুই মেয়েকে নিয়েই যেন এক গলা জলে পড়েছে এরা। ফলে প্রতিবেশীদের আপ্যায়ন আর তাদের প্রশ্নবাণের ধাক্কা সামলাতে ফোড়ন পুড়ে যায়, মাছের ঝোলের তলা ধরে যায়, খাওয়া দাওয়া মাথায় ওঠে। 

গোটা দিন এই অকারণ কৌতূহলের ঢেউ সামলে সবাই বোঝে এই পরিবার সকলের কৌতুকের পাত্র হয়ে গেছে। সব ঠিক থাকলে আগামীকাল বাড়ি ফেরার কথা ছিল সব আত্মীয়দের। মনোজ তাই রাতের খাওয়ার আগে সকলকে ডেকে নেয়। 

মনোজ বলে, "শুধু শুধু ছুটি বাড়িয়ে এখন বসে থেকেও লাভ নেই। আর যা পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, এখানে থাকলে এত কথায় সমরদার আরও অসুস্থ হয়ে পড়ার চান্স। তার চেয়ে আপনারা আমাদের কারও বাড়িতে চলুন। কয়েকটা দিন রেস্ট নিয়ে আসবেন। ততদিনে এসব কথাও একটু চাপা পড়বে, আর ওবাড়ি কি করে সেটাও দেখা যাবে।"

সমর আপত্তি করে, বিয়ের কাজে যাদের অর্ডার দেওয়া হয়েছে, ডেকরেটর, ক্যাটারার, এমনকি ফুলের লোক, সবারই কিছু কিছু পেমেন্ট বাকি। সেগুলো না দিয়ে চলে যাওয়া যায় না। গোপাও বলে, ঘরদোর একেবারে এলোমেলো হয়ে আছে। 

অমর বলে, "তাহলে আমার বাড়ি চলো। রিক্সা করেই যাতায়াত করা যাবে। দু একদিন পরে বৌদি আর দীপা এসে লোক লাগিয়ে সব গুছিয়ে যাবে। আর দাদা ফোনে কথা বলে কাকে কখন পেমেন্ট করবে টাইম দিয়ে, এসে টাকা দিয়ে যাবে।"

সমরের এতেও আপত্তি। এত টানাহ্যাঁচড়া পছন্দ না। আর বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে লোকের আরও সাহস বাড়বে, ভাববে, ওরা ভয়ে বা লজ্জায় পালিয়েছে। তাই ওরা স্বামী স্ত্রী এখানেই থাকবে, ধীরে ধীরে কাজগুলো সারবে। অমর আর দীপা, বা ওদের ছেলে অঙ্কুর এসে দেখা সাক্ষাৎ করে যাবে। বরং এরা কেউ মিলিকে সঙ্গে নিয়ে যাক। মেয়েটা এসে থেকে মুখ শুকিয়ে বসে আছে, খাওয়া দাওয়ার তো লক্ষণ নেই। 

সবাই স্বীকার করে বুদ্ধিটা ভালই। শ্যামলের মেয়ে রিমা মিলির দুবছরের ছোট, বেশ বন্ধু ওরা। প্রায়ই ছুটিছাটায় মামার বাড়ি গিয়ে থাকে মিলি। তাই রমলা প্রথমেই বলে, "মিলিকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। রিমার সঙ্গে থাকলে ভাল থাকবে।"

অমর জানায়, এ সপ্তাহে ওরা বাড়ি ফিরছে না। এ বাড়ি থেকে ওর অফিস যাতায়াতের কোনো অসুবিধা নেই। অঙ্কুরের কলেজ, টিউশনের জন্য বাড়ি থেকে বইপত্র নিয়ে নেবে, যাতায়াত করবে। সাত আট মাসের ছোট বড় অঙ্কুর আর মিলি, বরাবর একসঙ্গে পড়াশোনা করেছে, এখনও এক কলেজের, এক বিষয়ের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রছাত্রী দুই ভাইবোনের জীবন দুদিকে বাঁক নেয়।

🍂🌿🍂🌿🍂🌿🍂

একটি দুটি করে দিন গড়িয়ে যাচ্ছে। সপ্তাহ শেষের আগেই রনি বাড়িতে ফিরে এসেছে। দিব্যি ইউনিভার্সিটি যাতায়াত করছে দেখা যাচ্ছে। তবে ওদের বাড়ির দিকে ভুলেও তাকায় না, মাথা নিচু করেই গলিটা পার হয়। একা রনি না, বনিও। 

একদিন সন্ধ্যায় পাড়ার স্টেশনারি দোকানে মুখোমুখি হয়ে গেছিল গোপা আর পিউ, গোপা বেরোচ্ছে, পিউ ঢুকছে। পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এলো গোপা। একমুহূর্ত থমকে গেলেও পিউ তারপর ছুটে এসে পাশাপাশি হলো, "কাকিমা, কেমন আছো?"

- "ভাল আছি রে।" একগাল হাসে গোপা। ততক্ষণে মনে পড়েছে, দেওর - জা, দাদা - বৌদি, বোন - ভগ্নীপতি, সবাই বারবার বলেছে, যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকো। লোকে ধীরে ধীরে চুপ করে যাবে। গোপার পালটা প্রশ্ন, "তোরা সবাই ভাল তো?" পিউ ঘাড় কাত করতেই গোপা হাঁটা দিল। কেউ জানলো না, কেউ দেখেনি, একসময় যথার্থ বন্ধু হয়ে ওঠা এই অসমবয়সী মানুষগুলোর আজ খারাপ লাগাটা শুধু দুজনের মধ্যে রয়ে গেল। 

মিলির বিয়ের দু মাস পূর্ণ হতে যখন ঠিক চারদিন বাকি রমলা ফোন করলো গোপাকে, একথা সেকথার পর বলল, আগামীকাল সবাই আসছে, সঙ্গে মিলিও। মিলিকে নিয়েই কথাও আছে। 

গোপা ভাবে, কি আর কথা মিলিকে নিয়ে? নতুন করে তো কিছু ঘটেনি। মিলিও সারাদিন চুপচাপ বসে থাকে। এই তো গোপা আর সমর মাসখানেক আগে ঘুরে এলো ওখানে। গোপার বোন তপতীরাও সবাই এসেছিল। নিজের চোখেই দেখেছে, নিশ্চুপ মিলিকে। সে কি কোনো অসুবিধা ঘটালো? ওরা ওকে ওখানে রাখতে চায় না আর? নাকি অনেকগুলো দিন হয়ে গেল, এবার ওবাড়ির বিরুদ্ধে কেস করার সময় এসেছে? 

সমরকে রমলার ফোনের কথা বলে রাখে। দুজন মিলে বহু জল্পনা করে বাজিও ধরে, কার কথা ঠিক হয়?

চলবে