ঝরাপাতা
পর্ব - ৯
🏜🍂🏜🍂🏜🍂🏜
সাধারণত সন্ধ্যায় সাড়ে ছ টা থেকে সাতটার মধ্যে আগে পরে বাড়ি ফেরে বনি আর রনি। আজও বনি আগে ঢুকল, ওকে চা দিয়েই টিভি চালিয়ে বসে গেছে পিউ। এ চ্যানেল ও চ্যানেল দেখছে ঘুরে ঘুরে। বনি একটু অবাক, ওর এত টিভির নেশা কখন হল যে একটাও কথা বলছে না?
রনি এসে টুকটাক কথা বলছে মা, দাদার সঙ্গে, পিউ এতক্ষণ টিভিটা মিউট করে রেখেছিল। এখন কি একটা চ্যানেলে নাচ গান হচ্ছে, সেটা সাউন্ড অন করে দেখতে শুরু করল। এদের কথা বলতে একটু অসুবিধা হচ্ছে, তাকাচ্ছে ওর দিকে। কোনো হুঁশ নেই, বরং ধাপে ধাপে আওয়াজ বাড়াচ্ছে।
সবাই বিরক্ত হচ্ছে। পিউ বলেই কিছু বলতে পারছে না। ও খুব অকারণ কোনো ছেলেমানুষি উৎপাত করে এমন অসুবিধা করার মেয়ে নয়। তবুও বনির খারাপ লাগে। হালকাভাবেই বলে, "আঃ পিউ, আস্তে। এত জোরে টিভি চালিয়েছ, কি প্রোগ্রাম আছে আজ?"
কট করে টিভিটা বন্ধ করে পিউ বলে, "আজ আমার মন খুব খুশি হয়ে আছে। তাই একটু আনন্দ করলাম।"
- "কিসে এত আনন্দ হল হঠাৎ?" বনি অবাক। অনেক আনন্দের মুহূর্তেও এভাবে একা জোরে টিভি চালাতে দেখেনি পিউকে।
- "আনন্দ হবে না, কি বলো? এই যে লিলি আমাদের একটা বিশ্রী অবস্থায় ফেলেছিল, ওরই বোন মিলির সঙ্গে রনির বিয়ে দিয়ে আমরা সেই সময়টাকে আবার আমাদের দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারলাম। তার উপর মিলিকে কেমন এ্যাভয়েড করে লিলির কাজটার শোধও নেওয়া হয়ে গেল।"
কি সব বলছে পিউ? মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? বনি তাড়াতাড়ি বলে, "এসব কি বলছ তুমি? সমরকাকুর শরীরটা খারাপ শুনেই মা মিলিকে পাঠিয়েছিল। তা ওরা মিলিকে নাকি মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। তার মধ্যে এসব কথা আসছে কেন?"
- "আসছে, কারণ ওদের বাড়ি থেকে যারা এসেছিল, তারা বলেছিল সমরকাকু সেদিন ভাল আছে, সুস্থ হয়ে উঠছে। তাও তোমার ভাই পালিয়ে গেছিল বলে, যদি ভেবেও থাকো, মিলি বাবাকে দেখে আসুক.... "
পিউকে থামাতে বনি বলে, "তাই তো ভেবেছিল মা। রনি যখন নেই, মিলি কদিন বাবার কাছে থাক, বাচ্চা মেয়ে.... "
- "রনি ছিল না কেন? এই তো তোমার ভাই সামনে আছে, বলো, কি করছিল ও?"
রনির রাগে কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। একে তো যা কিছু ও ভুলতে চায়, সেই কথাগুলো বৌদি বলতে শুরু করেছে, তার উপর ওকে রনি বলেই কখনো ডাকে না, আজ কতগুলো বছর ধরে ভাই বলে, অথচ আজ দাদাকে বলছে, "তোমার ভাই"।
- "আহ পিউ, কি হচ্ছেটা কি? তুমি যদি সব জেনে বুঝে..... " মণিকা পিউকে ধমকে থামাতে চায়।
- "ভুল বলছ মামনি, আমি কিছু জানি না। বুঝতে পারা দূরের কথা। তোমার একার নয়, আমাদের প্রত্যেকের মনে হয়েছিল, এত লোকের সামনে লিলি আমাদের নাক কেটে দিল। আজ যদিও আমি বুঝেছি, সেটা ভুল ধারণা। সেদিন সবাই তোমার রনিকে বলেছিলাম, আমি, এই আমি," নিজের বুকে আঙ্গুল ঠুকে পিউ বলে চলে, "আমি বলেছিলাম, মিলির তো কোনো দোষ নেই, তাহলে ওকে বিয়ে করতে আপত্তি কোথায়? যদি তোমার ছেলের মনে ওদের উপর শোধ নেওয়ার প্ল্যান না থাকত, তবে বলতে পারত, বিয়ে করবে না। না, বিয়ে করল, পরিবারের মান বাঁচাতে বিয়ে করছি নাটক করে বিয়ে করল। তারপর বাড়ি থেকেই চলে গেল। আর প্ল্যানমাফিক মেয়েটাকে সকালবেলা বাড়িতে পাঠিয়ে দিলে তোমরা। কি যুক্তি? ওর বাবা অসুস্থ ! বা রে বা ! সমরকাকু এত অসুস্থ যে মিলিকে এ বাড়িতে রাখা যায় না, অথচ সমরকাকুর স্বাস্থ্যের খবর নিতে কেউ এগোলে না।"
- "তুই তো আজ গেছিলি খবর নিতে। সেখান থেকে এসব শিখে এসেছিস? তারপর আমাদের শান্তি নষ্ট করতে এই কান্ডটা করছিস?" মণিকা রীতিমতো ক্ষিপ্ত।
- "হ্যাঁ মামনি, ওবাড়িতে গেছিলাম। তোমাকে বলেই গেছিলাম। কারণ আজ মিলিকে ফিরতে দেখলাম। যদিও সে মিলি বলে ভাবা যায় না। সেজন্যই ছুটে গেছিলাম। ভাগ্যিস গেছিলাম ! নাহলে এত খুশির খবর তো জানতে পারতাম না।"
- "কি খুশির খবর?" চোখ সরু করে প্রশ্ন করে বনি। এত বছরের সঙ্গী পিউ, তাকে ও চেনে। এতক্ষণে ও বুঝেছে, পিউ কিছু বলতে চায়, যেটা হয়তো সহজ কথা নয়।
গলায় শ্লেষ ফেটে পড়ছে, পিউ বলে চলে, "সে যে কি খুশির খবর ! মামা মামীর সঙ্গে এসে নামল মিলি, আমার দোতলার বারান্দা থেকে দেখেই সন্দেহ হয়েছিল। ওদের বাড়ি গিয়ে দেখি, মিলি তো না, মিলির একটা কালো ছায়া যেন ফিরে এসেছে। কোথায় ওর হাসি আড্ডা গান? কোথায় সেই বক্তিয়ার মিলি? ও আর কথা বলেনা।"
- "কথা বলেনা?" বনির ভয় ভয় করছে।
- "হ্যাঁ গো," ভেংচি কাটার মতো ব্যঙ্গ করে খুশিভরা গলায় পিউ বলছে, "একটাও কথা বলে না। প্রথমদিকে একটা দুটো কথা বলত বারবার জিজ্ঞেস করলে। এখন কমতে কমতে পুরো বন্ধ। তার সঙ্গে গুটিকতক চেনা লোক ছাড়া কাউকে দেখতে পেলে হিস্টিরিক হয়ে যায়। সারাদিন ঘর অন্ধকার করে বসে থাকে।"
- "কি বলছ তুমি? এরকম কি করে হল?" বনি আঁতকে ওঠে।
- "এরকমই তো হওয়ার কথা। লিলির জন্য শকটা আর সবার মতো মিলিরও লেগেছিল, ওরও সকলের অপমানজনক কথার ভয় করেছিল। মিলিও বাড়ির সম্মানের কথা ভেবে এক মুহূর্তের নোটিশে বিয়ে করেছে, আর সে মেয়ে তোমার ভাইয়ের চেয়ে বয়েস, অভিজ্ঞতা, শিক্ষাদীক্ষা, সবদিকে ছোট। তোমার ভাইয়ের উপর অত্যাচার হয়েছে, ওর উপর হয়নি? আর তারপরের অপমানটা ভেবো। বাকি গোটা জীবন ধরে ভেবো। যে অপমান, লোকের কথা থেকে বাঁচতে এই বিয়ে হল, তোমার ভাই তো সেগুলো উসকে দিল আরও। তার মানে মায়ের অপমান আটকাতে ও বিয়ে করেনি, শোধ নিতেই করেছে। আর তোমরা ওকে ফুল সাপোর্ট দিয়েছ।"
- "না, পিউ, রনির সামনেই বলছি, একফোঁটাও সাপোর্ট করিনি আমি। কিন্তু ওকে জোর করে ধরে এনে একটা মেয়ের সঙ্গে সংসার করানো তো যায় না, তার উপর মা বোঝাতেও দিচ্ছে না, তাই চুপ করে ছিলাম। যদি রনি আবার কিছু কান্ড করে আমি দোষের ভাগী হবো বলে, চুপ করে ছিলাম।" বনি একবার বিরক্ত মুখে ভাইয়ের দিকে তাকায়, তারপর বলে যেতে থাকে, "এত ইরেসপন্সেবল, এত অমানবিক আমার ভাই হতে পারে, কখনো ভাবিনি।"
- "ওকে দোষ দিচ্ছ কেন? তোমারও তো একবার খবর নেওয়ার কথা মনে হয়নি।" বনির উপরেও পিউয়ের আলাদা করে রাগ আছে বোঝা যায়।
- "সাহসই হয়নি। কি বলতাম গিয়ে? কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতাম? ভেবেছিলাম, মিলি এখানে নেই, আজেবাজে কথা শুনতে হচ্ছে না ওকে। রনিকে আরেকটু সময় দিয়ে যদি বোঝাতে পারি।" বনি উঠে পায়চারি করছে, "খুব ভাল করেছ, তুমি ওদের বাড়িতে গেছিলে। যা আমি পারিনি সেটা তুমি করেছ।"
- "আর কিচ্ছু ভাল হবে না বনি," ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে পিউ, "মিলিকে তো দেখলাম। কতদিন খায়নি, ঘুমোয়নি, কথা পর্যন্ত বলছে না। পাগল হয়ে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে ওর জ্বর হয়েছিল। ওরা ডাক্তার দেখিয়েছিল, বাইরে বেরোতে হয়েছে, তাতে আরও গুটিয়ে গেছে। সেই ডাক্তার ওকে জ্বরের ওষুধ দিয়েছেন, সব টেস্ট করিয়েছেন, ওর রক্তে হিমোগ্লোবিন কম, আয়রনের অভাব, সোডিয়াম কম। উনি পরিস্থিতি দেখে প্রশ্ন করে করে ওর কাহিনী শুনেছেন। ওর মামা মামীকে পর্যন্ত যাচ্ছেতাই করেছেন, ওকে সাইকায়াট্রীট কনসাল্ট করতে বলেছেন। ওর বাবা মায়ের সঙ্গে রাখতে বলেছেন। কি করে রাখবে এখানে? এই তো আমি গেলাম, বসে ছিল। আমাকে দেখে কি ভয়, পালিয়ে গিয়ে পর্দার পিছনে লুকোলো।" পিউর চোখের জল বন্ধ হচ্ছে না।
- "এসে তো কিছু বললি না আমাকে?" মণিকা কোনোমতে ঢোঁক গিলে বলল।
[ যারা আগের পর্ব পড়তে আগ্রহী, তাদের অনুরোধ #ঝরাপাতা এই হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে অথবা আমার নামে গ্রুপে সার্চ করতে। ]
চলবে