Part 4: “মায়ার রাতের প্রথম মুখোমুখি”
রাতটা ছিল অদ্ভুত শান্ত।
যেন আকাশও থেমে গেছে,
শুধু বাতাসের মধ্যে এক অদ্ভুত উত্তাপ—
যে উত্তাপ ভয় ও আকর্ষণের মাঝামাঝি কোথাও।
ইরা বিছানায় শুয়ে ভাবছিল শুধু একটাই নাম—
মায়া।
তার কথা…
তার ছোঁয়া…
তার ভয়…
আর সেই কানের কাছে ফিসফিস—
“রাত নামলে আমার ওপর বিশ্বাস ভেঙে যায়।”
ইরার মাথা যেন ছটফট করছিল।
এটা কোনো সাধারণ রহস্য নয়।
এটা এমন কিছু যা
মায়াকে ভেঙে দিচ্ছে—
কিন্তু সে কাউকে জানাতেও ভয় পাচ্ছে।
ঠিক তখনই ফোনের ভেতর ছোট্ট একটা শব্দ হলো—
টিং।
মায়া: "বাইরে এসো। একদম এখনই।"
ইরার বুক ধাক্কা খেল।
রাত সাড়ে দশটা। মায়া কি ঠিক আছে?
জানালার পাশে গিয়ে নিচে তাকাতেই
সে দেখল—
রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে আছে মায়া।
চুল সম্পূর্ণ ভেজা।
কোনো ছাতা নেই।
রাস্তার লাইটে তার ছায়া লম্বা হয়ে গেছে।
কিন্তু…
আজ মায়াকে দেখে যেন অন্য কেউ মনে হলো।
চোখ দুটো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কালো।
শরীরের ভঙ্গি শক্ত, খাঁচায় বন্দি বাঘিনীর মতো।
কিছু একটা খুব ভুল।
ইরা তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এলো।
দরজা খুলতেই
তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা…
সে কি সত্যিই আগের সেই নরম মায়া?
না।
এটা অন্য অনুভূতি।
অন্য উষ্ণতা।
অন্য গন্ধ।
মায়া ঠান্ডা কণ্ঠে বলল—
— “চলো।”
ইরা অবাক। — “কোথায়?” — “চুপচাপ চলো।”
মায়া হাত ধরতেই
ইরা শিউরে উঠল।
হাতটা বরফ ঠান্ডা।
যেন সে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
ইরা কাঁপা গলায় বলল— — “মায়া… তুমি কাঁদছ? তোমার চোখ লাল কেন?”
মায়া তার দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
— “জিজ্ঞেস কোরো না।”
— “কিন্তু তুমি—”
— “আমি বলেছি, জিজ্ঞেস কোরো না।”
তার কণ্ঠশব্দে
একটা ভয়ের কম্পন ছিল।
ইরা বুঝল—
আজ মায়ার মাথার ভেতর ঝড় চলছে।
দুজনে রাস্তা দিয়ে যেতে লাগল।
বাতাস জোরে বইছিল।
কুকুরগুলো অস্বাভাবিকভাবে হাউল করছিল।
ইরার মনে অদ্ভুত আতঙ্ক জন্মাচ্ছিল।
হঠাৎ মায়া থেমে গিয়ে বলল—
— “তুমি আমাকে কেন ভালোবাসার চোখে দেখছিলে সেদিন?”
ইরা থমকে গেল।
— “আমি? ভালোবাসার চোখে?”
— “হ্যাঁ। তুমি লুকোতে পারো… কিন্তু তোমার চোখ পারে না।”
— “কিন্তু তুমি তো—”
মায়া তার কাছে এসে দাঁড়াল।
এত কাছে
যে ইরা তার নিঃশ্বাস বুকে অনুভব করল।
মায়ার গলায় প্রচণ্ড ব্যথা মেশানো কণ্ঠ—
— “ইরা… আমার ওপর প্রেম করা মানে ধ্বংস ডেকে আনা।”
ইরার চোখ ভিজে উঠল।
— “আমি তো বলেছি… আমি তোমাকে ছাড়ব না।”
— “হয়তো তোমারই উচিত ছিল।”
মায়ার ঠোঁট কাঁপছিল।
চোখের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছিল।
অন্ধকারের মধ্যে
মায়ার মুখটা আজ
দুটো আলাদা ছায়ায় ভাগ হয়ে গেছে—
একটা কোমল,
একটা শিকারীর মতো ধারালো।
হঠাৎ দূর থেকে একটা গাড়ির হর্ন বাজল।
ভাগ্যিস সে শব্দটা হলো—
নইলে বাতাস থেমে যেত।
মায়া নিঃশ্বাস ফেলল।
— “চলো। তোমাকে কিছু দেখাতে চাই।”
---
অবৈধ বাগান — রাত ১১:০৫ মিনিট
মায়া ইরাকে নিয়ে এল একটা পুরনো বাড়ির পেছনের গোপন বাগানে।
ঝোপঝাড়, ভাঙা বেঞ্চ, ভেজা মাটি।
চারদিকে গাছ, ছায়া, আর ভয়।
ইরা ধীরে বলল— — “এখানে এনেছ কেন?”
মায়া একদম চুপ।
তার শ্বাস দ্রুত উঠানামা করছিল।
হঠাৎ মায়া তার চুল ধরে মাথা নিচু করল।
— “শোনো। আমি যা দেখাব সেটা দেখে তুমি পালাতে চাইবে।”
ইরার হৃদপিণ্ড যেন গলা দিয়ে বেরিয়ে আসছে।
— “মায়া… আমি ভয় পাচ্ছি।”
মায়া চোখ বন্ধ করে ধীরে বলল— — “আমার ভয় করারই কথা।”
ইরা স্তব্ধ।
মায়া তার হাত তুলে ধরল—
ওই হাতই, যেখানে ক্ষত ছিল।
আজ হাতের রেখাগুলো যেন আরও গাঢ়, আরও গভীর।
মায়া ধীরে বলল—
— “এগুলো আমার বাবা-মা দেয়নি।
এগুলো আমি পাই…
প্রতি রাতে।”
ইরা চোখ বড় করে তাকাল।
— “প্রতি রাতে? মানে…?”
— “মানুষ না…
নিজের ভেতরের অন্ধকার আমাকে দেয়।”
ইরা কেঁপে উঠল।
— “তোমার ভেতরের… অন্ধকার?”
— “হ্যাঁ। আমার একটা দিক আছে—
যে দিকটা আমি কাউকে জানাতে চাই না।”
— “কেন আমাকে দেখাতে চাইছ তাহলে?”
মায়া নিঃশ্বাস নিয়ে বলল—
— “কারণ তুমি আমার জীবনে ঢুকে পড়েছ।
আর আমি চাই বা না চাই—
তোমাকে থেকে যেতে হবে এই পথেই।”
ইরা চোখের জল ফেলল।
— “মায়া… তুমি কী বলছ?”
মায়া আর তাকাতে পারছিল না।
মুখ ঘুরিয়ে নিচু গলায় বলল—
— “রাত নামলে আমি বদলে যাই, ইরা।
আমি সেই মায়া থাকি না।
আমার শরীর, আমার চোখ,
আমার রাগ…
সবই অন্যরকম হয়ে যায়।”
ইরা কাঁপা গলায় বলল— — “তাহলে… তুমি কি ভৌতিক কিছু? নাকি—”
মায়া তার ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরল।
— “না। আমি কোনো অলৌকিক কিছু না।
আমি মানুষ।
কিন্তু আমার জীবনটা… একটা খাঁচা।”
ইরা হাত ধরতেই
মায়া আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল—
— “আর আজ রাত…
সেই খাঁচা খুলে যাওয়ার রাত।”
হঠাৎ বাতাস তীব্র হয়ে উঠল।
গাছের পাতা উড়ে উঠল।
ইরার মনে হলো
মাটি কাঁপছে।
মায়ার শ্বাস দ্রুত হয়ে গেল।
তার চোখ দুটো লালচে।
ঠোঁট কামড়াচ্ছে।
শরীর কাঁপছে।
ইরা ভয় পেয়ে বলল— — “মায়া! তুমি ঠিক আছ? কি হচ্ছে?”
মায়া হাঁটুতে বসে পড়ল।
শরীর বাঁকা হয়ে উঠল।
যেন প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে।
— “পেছনে যাও! ইরা, পেছনে যাও!”
— “না! তোমাকে একা ছাড়ব না!”
— “আমি বলেছি পিছনে যাও!!”
মায়ার চোখ একমুহূর্তে
অস্বাভাবিক উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
ইরা কাঁদতে কাঁদতে বলল— — “মায়া… আমার দিকে তাকাও… প্লিজ…”
মায়ার চোখের জল পড়তে লাগল।
সে ফিসফিস করল—
— “আমি চাই না তুমি আমাকে এভাবে দেখো…
কিন্তু আজ তোমার সামনে সব হবে।”
হঠাৎ মায়ার শরীরটা থেমে গেল।
একদম নিথর।
তারপর সে খুব আস্তে মাথা তুলল।
চোখ—
আর আগের মায়ার চোখ নেই।
ওগুলো…
গভীর, অন্ধকার, ক্ষুধার মতো।
ইরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল।
মায়া উঠে দাঁড়াল।
ধীরে ধীরে।
একটা ভাঙা পুতুলের মতো।
এটা আগের সেই মায়া নয়—
যে হাসে, রাগ করে, কাঁদে।
এটা যেন তার ভেতরের
অন্ধকার সংস্করণ।
মায়া ইরার দিকে তাকিয়ে বলল—
— “এটাই আমার রাতের রূপ।”
ইরা পিছিয়ে গেল।
তার চোখে পানি।
মুখে ভয়।
কিন্তু মায়ার রাতের রূপ
হেঁটে কাছে এসে বলল—
— “ভয় পেও না।
রাতের আমি
তোমাকে আঘাত করব না…
যদি তুমি আমায় ছেড়ে না যাও।”
ইরা কাঁদা কণ্ঠে বলল— — “আমি কখনও তোমাকে ছাড়ব না।”
অন্ধকার-মায়া মৃদু হাসল।
— “তাহলে তুমি ভুল পথে ঠিকই এসেছ…”
তার ঠোঁট ইরার গালে ছুঁয়ে বলল—
— “কারণ তোমাকে অন্ধকারও ভালোবেসে ফেলেছে।”
ঠিক তখনই
বাগানের বাইরে কেউ ছায়ার মতো নড়ল।
মায়া এক ঝটকায় ঘুরে দাঁড়াল।
চোখ দাউ দাউ করে জ্বলছে।
— “কে সেখানে?”
ইরা প্রথমবার বুঝল—
মায়ার রাতের রূপ শুধু ভয়ংকর নয়,
সুরক্ষাকারীও।
আর তার ভেতরের এই অন্ধকার
ইরাকে আঘাত করবে না—
কিন্তু যে কেউ ইরার কাছে আসলে
সেটাকে মায়া সহ্য করবে না।
ইরা কেঁপে উঠে ভাবল—
এই মায়াকে সে কি ভালোবাসতে পারবে?
নাকি এই মায়াই তাকে শেষ পর্যন্ত গ্রাস করবে?
গল্প এখান থেকে আরও ভয়ঙ্কর,
আরও রোম্যান্টিক,
আরও জটিল হবে।
---
চলবে ___