Story of Mahabharat Part 161 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 161

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 161

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৬১

শল্যের সেনাপতিত্বে অভিষেক ও অষ্টাদশ দিনের যুদ্ধে শল্যবধ

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

শল্যের সেনাপতিত্বে অভিষেক ও অষ্টাদশ দিনের যুদ্ধে শল্যবধ

কৌরবপক্ষীয় বীরগণ দুর্যোধনকে বললেন, মহারাজ, আপনি নতুন সেনাপতি নিযুক্ত করে যুদ্ধ করুন, আমরা তাঁর দ্বারা রক্ষিত হয়ে শত্রুকে জয় করবো। দুর্যোধন রথে চড়ে অশ্বত্থামার কাছে গেলেন — যিনি তেজে সূর্যতুল্য, বুদ্ধিতে বৃহস্পতিতুল্য, যাঁর পিতা অযোনিজ এবং মাতাও অযোনিজা, যিনি রূপে অনুপম, সর্ববিদ্যায় বিদ্বান এবং গুণের সাগর। দুর্যোধন তাকে বললেন, গুরুপুত্র, এখন আপনিই আমাদের পরমগতি, পরামর্শ দিন কে আমাদের সেনাপতি হবেন।

অশ্বত্থামা বললেন, শল্যের কুল রূপ তেজ যশ শ্রী সর্বপ্রকার গুণই আছে, ইনিই আমাদের সেনাপতি হওয়ার উপযুক্ত। এই কৃতজ্ঞ নরপতি নিজের ভাগ্নেদেরকে ত্যাগ কোরে আমাদের পক্ষে এসেছেন। ইনি মহাসেনার অধীশ্বর এবং কার্তিকের ন্যায় মহাবাহু। দুর্যোধন ভূমিতে দাঁড়িয়ে কৃতাঞ্জলি হয়ে রথ আসীন শল্যকে বললেন, মিত্রবৎসল, মিত্র ও শত্ৰু পরীক্ষা করবার সময় উপস্থিত হয়েছে, আপনি আমাদের সেনার সম্মুখে থেকে নেতৃত্ব করুন, আপনি রণস্থলে গেলে মন্দমতি পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ এবং তাদের অমাত্যবর্গ নিরুদ্যম হবে। মদ্ররাজ শল্য উত্তর দিলেন, কুরুরাজ, তুমি আমাকে দিয়ে যা করাতে চাও আমি তাই করবো, আমার রাজ্য ধন প্রাণ সবই তোমার প্রিয়সাধনের জন্য। দুর্যোধন বললেন, অতুলনীয় বীরশ্রেষ্ঠ মামা, আপনাকে সেনাপতিত্বে বরণ করছি, কার্তিক যেমন দেবগণকে রক্ষা করেছিলেন সেইরূপ আপনি আমাদের রক্ষা করুন। শল্য বললেন, দুর্যোধন, শোন - কৃষ্ণ আর অর্জুনকে তুমি রথিশ্রেষ্ঠ মনে করো, কিন্তু তারা বাহুবলে কিছুতেই আমার তুল্য নন। আমি ক্রুদ্ধ হলে দেবতা, অসুর ও মনুষ্য সমেত সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারি, পাণ্ডবরা তো দূরের কথা। আমি সেনাপতি হয়ে জয়লাভ করবো এতে সন্দেহ নেই।

দুর্যোধন শল্যকে যথাবিধি সেনাপতির পদে অভিষিক্ত করলেন। সৈন্যেরা সিংহনাদ কোরে উঠল, নানাপ্রকার বাদ্যধ্বনি হোলো, কৌরব ও মদ্রদেশীয় যোদ্ধারা খুশি হয়ে শল্যের স্তুতি করতে লাগলেন। সকলে সেই রাত্রিতে সুখে নিদ্রা গেলেন।

পাণ্ডবশিবিরে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বললেন, মাধব, দুর্যোধন মহাধনুর্ধর শল্যকে সেনাপতি করেছেন। তুমিই আমাদের নেতা ও রক্ষক, অতএব এখন যা কর্তব্য তার ব্যবস্থা করো। কৃষ্ণ বললেন, ভরতনন্দন, আমি শল্যকে জানি, তিনি ভীষ্ম দ্রোণ ও কর্ণের সমান অথবা তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। শল্যের শক্তি ভীম অর্জুন সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডীর অপেক্ষা অধিক। পুরুষশ্রেষ্ঠ, আপনি বিক্রমে শার্দুলতুল্য, আপনি ভিন্ন অন্য পুরুষ পৃথিবীতে নেই যিনি যুদ্ধে মদ্ররাজকে বধ করতে পারেন। তিনি সম্পর্কে মামা এই ভেবে দয়া করবেন না, ক্ষত্ৰধর্মকে অগ্রগণ্য কোরে শল্যকে বধ করুন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণের মতো সাগর পার হয়ে এখন শল্য-রূপ গোস্পদে ডুবে যাবেন না। এইপ্রকার উপদেশ দিয়ে কৃষ্ণ সন্ধ্যায় তার শিবিরে প্রস্থান করলেন। কর্ণবধে আনন্দিত পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ সেই রাত্রিতে সুখে নিদ্রা গেলেন।

পরদিন সকালে কৃপ কৃতবর্মা অশ্বত্থামা শল্য শকুনি প্রভৃতি দুর্যোধনের সঙ্গে মিলিত হয়ে এই নিয়ম করলেন যে তারা কেউ একাকী পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না, পরস্পরকে রক্ষা কোরে মিলিত হয়েই যুদ্ধ করবেন। শল্য সর্বতোভদ্র নামক ব্যূহ রচনা করলেন এবং মদ্রদেশীয় বীরগণ ও কর্ণপুত্রদের সঙ্গে ব্যূহের সামনে রইলেন। ত্রিগর্তসৈন্য সহ কৃতবর্মা ব্যূহের বামদিকে, শক ও যবন সৈন্য সহ কৃপাচার্য দক্ষিণে, কম্বোজ সৈন্য সহ অশ্বত্থামা পিছন দিকে, এবং কুরুবীরগণ সহ দুর্যোধন ব্যূহের মাঝখানে অবস্থান করলেন। পাণ্ডবগণও নিজেদের সৈন্য ব্যূহবদ্ধ কোরে দুই ভাগে ভাগ করে অগ্রসর হলেন। কৌরবপক্ষে এগার হাজার রথী, দশ হাজার সাত শ গজারোহী, দুই লক্ষ অশ্বারোহী ও তিন কোটি পদাতিক এবং পাণ্ডবপক্ষে ছয় হাজার রথী, ছয় হাজার গজারোহী, দশ হাজার অশ্বারোহী ও দু কোটি পদাতিক অবশিষ্ট ছিলো।

দুই পক্ষের তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হোলো। কর্ণপুত্র চিত্রসেন সত্যসেন ও সুশৰ্মা নকুলের হাতে নিহত হলেন। পাণ্ডবপক্ষের হাতি ঘোড়া রথী ও পদাতিক সৈন্য শল্যের বাণে নিপীড়িত ও বিচলিত হোলো। সহদেব শল্যের পুত্রকে বধ করলেন। ভীমের গদাঘাতে শল্যের চার ঘোড়া নিহত হোলো, শল্যও তোমর নিক্ষেপ কোরে ভীমের বুকে বিদ্ধ করলেন। ভীম অবিচলিত থেকে সেই তোমর টেনে নিলেন এবং তারই আঘাতে শল্যের সারথিকে বধ করলেন। পরস্পরের প্রহারে দুজনেই গুরুতর হলে, কৃপাচার্য শল্যকে নিজের রথে তুলে নিয়ে চলে গেলেন। ক্ষণকাল পরে ভীম উঠে দাঁড়ালেন এবং মদ্ররাজকে আবার যুদ্ধে আহ্বান করলেন।

দুর্যোধনের প্রাসের আঘাতে যাদববীর চেকিতান নিহত হলেন। শল্যকে সামনে রেখে কৃপাচার্য কৃতবর্মা ও শকুনি যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে এবং তিন হাজার রথী সহ অশ্বত্থামা অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির তার ভাইদের এবং কৃষ্ণকে ডেকে বললেন, ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ ও অন্যান্য পরাক্রান্ত বহু রাজা কৌরবদের জন্য যুদ্ধ কোরে নিহত হয়েছেন, তোমরাও উৎসাহের সঙ্গে নিজ নিজ পুরুষকার দেখিয়েছ। এখন আমার জন্য কেবল মহারথ শল্য অবশিষ্ট আছেন, আজ আমি তাকে যুদ্ধে জয় করতে ইচ্ছা করি। বীরগণ, আমার সত্য বাক্য শোন — আজ শল্য আমাকে বধ করবেন অথবা আমি তাকে বধ করবো, আজ আমি বিজয়লাভ বা মৃত্যুর জন্য ক্ষত্রধর্মানুসারে মামার সঙ্গে যুদ্ধ করবো। রথ সজ্জাকারীগণ আমার রথে প্রচুর অস্ত্র ও অন্যান্য উপকরণ রাখুক। সাত্যকি দক্ষিণচক্র, ধৃষ্টদ্যুম্ন বামচক্র এবং অর্জুন আমার পিছন দিক রক্ষা করুক, ভীম আমার সামনে থাকুক, এতে আমার শক্তি শল্য অপেক্ষা অধিক হবে। যুধিষ্ঠিরের হিতাকাঙ্খীগণ তার আদেশ পালন করলেন।

দুই শার্দুলের মতো যুধিষ্ঠির ও শল্য বিবিধ বাণ দ্বারা পরস্পরকে প্রহার করতে লাগলেন, ভীম ধৃষ্টদ্যুম্ন সাত্যকি, নকুল ও সহদেব শকুনি প্রভৃতির সঙ্গে যুদ্ধে রত হলেন। কৌরবগণ আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির যিনি পূর্বে মৃদু ও শান্ত ছিলেন, এখন তিনি দারুণ ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে ভল্লের আঘাতে বাহু সংখ্যক যোদ্ধাকে বধ করছেন। যুধিষ্ঠির শল্যের চার ঘোড়া ও সারথিকে বিনষ্ট করলেন, তখন অশ্বত্থামা দ্রুত এসে শল্যকে নিজের রথে তুলে নিয়ে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে শল্য অন্য রথে চড়ে আবার যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করলেন।

শল্যের চার বাণে যুধিষ্ঠিরের চার ঘোড়া নিহত হোলো, তখন ভীমসেনও শল্যের রথের চার ঘোড়া ও সারথিকে বিনষ্ট করলেন। শল্য রথ থেকে নেমে খড়্গ ও ঢাল নিয়ে যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধাবিত হলেন, কিন্তু ভীমসেন শরাঘাতে শল্যের ঢাল এবং ভল্ল দ্বারা তার খড়গের মুষ্টি ছেদন করলেন। যুধিষ্ঠির তখন কৃষ্ণের উপদেশ স্মরণ কোরে শল্যবধে যত্নবান হলেন। তিনি ঘোড়া ও সারথিহীন রথে বসে থেকেই একটি উজ্জ্বল মন্ত্রসিদ্ধ শক্তি অস্ত্র নিলেন এবং ʼপাপী তুমি নিহত হওʼ – এই বলে মদ্ররাজকে লক্ষ্য কোরে নিক্ষেপ করলেন। প্রলয়কালে আকাশ থেকে পড়া বিশাল উল্কার মতো সেই শক্তি অস্ত্র স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে ছড়াতে মহাবেগে শল্যের দিকে গেল এবং তাঁর বর্ম ও বিশাল বক্ষ ছিন্ন কোরে ভূমিতে প্রবিষ্ট হোলো। বজ্রাহত পর্বতশৃঙ্গের মতো শল্য বাহু প্রসারিত কোরে নিহত হয়ে ভূমিতে পড়ে গেলেন।

শল্য নিপতিত হলে তাঁর কনিষ্ঠ ভাই যুধিষ্ঠিরের দিকে ধাবিত হলেন এবং বহু নারাচ নিক্ষেপ করে তাকে বিদ্ধ করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির শল্যের ভাইয়ের ধনু ও পতাকা ছেদন করে ভল্লের আঘাতে তার মাথা কেটে ফেললেন। কৌরবসৈন্য ভীত হয়ে হাহাকার কোরে পালাতে লাগল।

শল্য নিহত হোলে তার অনুচর সাত শত রথী কৌরবসেনা থেকে বেরিয়ে এলেন। সেই সময়ে একটি পর্বতাকার হাতিতে চড়ে দুর্যোধন সেখানে এলেন। একজন তার মাথার উপর ছাতা ধরেছিল, আর একজন তাকে চামর দিয়ে বাতাস করছিল। দুর্যোধন বার বার মদ্ৰযোদ্ধাদের বললেন, যাবেন না, যাবেন না। অবশেষে তারা দুর্যোধনের অনুরোধে ফিরে এসে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলেন। শল্য নিহত হয়েছেন এবং মদ্রদেশীয় মহারথগণ ধর্মরাজকে পীড়িত করছেন শুনে অর্জুন সত্বর সেখানে এলেন, ভীম নকুল সহদেব সাত্যকি প্রভৃতিও যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করবার জন্য বেষ্টন করলেন। পাণ্ডবগণের আক্রমণে মদ্রবীরগণ বিনষ্ট হলেন, তখন দুর্যোধনের সমস্ত সৈন্য ভীত ও চঞ্চল হয়ে পালাতে লাগল। বিজয়ী পাণ্ডবগণ শঙ্খধ্বনি ও সিংহনাদ করতে লাগলেন।

______________

(ক্রমশ)