ঝরাপাতা
পর্ব - ৪৮
❤💕❤💕❤💕❤
বাড়ি চলে আসে রনি। ওর পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব নয়। বাকিটা তখনই ঠিক হবে, যখন যুগল আর লিলির ভালোবাসাটা খাঁটি হবে। নিজের জীবনের কাছে রনি এই শিক্ষাই পেয়েছে, দাদাবৌদির ক্ষেত্রেও দেখেছে, সাময়িক সমস্যা আসতে পারে, আসবেও। তাতেই হয়ত সম্পর্কের এ্যাসিড টেস্ট হয়ে যায়। যুগল আর লিলিরও এখন সেই পর্যায় চলছে। একবার ওরা পাশ করেছে, নিজেরা যেভাবে প্ল্যান করেছিল ঠিক তার সময় যখন ঠিক তার বিপরীতে বইছিল, তখন। ওরা তখন কোনো দিকে তাকায়নি, শুধু নিজেদের সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখতে সকলের বিরুদ্ধে গেছে। আজ একসঙ্গে থাকবে কিনা, সেটা এবার ওদেরই ঠিক করতে হবে।
ওদের মাঝখানে যে বেনোজল ঢুকে পড়েছিল, রনি শুধু সেটাকে বাঁধ দিয়ে আটকে রেখেছে। তাও কিছু সময়ের জন্য।
রনি বেরিয়ে যেতে যুগল এসে লিলির সামনে বসে, "তুমি যা বলার আমাকে বলতে। পাপাজির কাছে রনিকে পাঠিয়ে, সলিসিটর ফার্মে পর্যন্ত জানিয়ে এত কাণ্ড করলে কেন?"
- "আমার কাজ তোমার পছন্দ না, আগেই বলেছ, এবার এই বাড়ি থেকে চলে যাও। আমি রনিদার সামনেই বলে দিয়েছি, তুমি চলে যাও। তোমার যেটা ভয় করছে এখন, এক পয়সাও আমাকে দিতে হবে না।"
- "ভয় পেয়ে বলছি না। আমাদের দুজনের কথা, এভাবে আমার বাড়িতে বললে কেন?"
- "আমাদের দুজনের আর কোনো কথা আছে? আমরা দুজন আর একসঙ্গে আছি? তোমাকে কোনো কথা বলতে গেলে আজকাল খ্যাঁক করে ওঠো। বাড়ির বাজার আনতে হবে বললে বলো, তার জন্য তোমার কেরিয়ার শেষ হয়ে যাচ্ছে। তুমিই বলেছ, তোমার বাড়ির লোকেরা তোমাকে ফিরে যেতে বলছে। আমাকে ডিভোর্স দিলেই তোমাকে ফিরিয়ে নেবে। তারা যদি জানে আমি কি ভাবছি, তাতে কি সমস্যা?"
- "কাদের ঝগড়া হয় না বলো? আমি কি বলেছি ডিভোর্স চাই? তোমরা আমাকে বললে না, ওখানে সবাইকে বলে এলে ডিভোর্স হচ্ছে?"
- "আমাদের ঝগড়া হয়েছিল? নাকি প্রত্যেক দিন তুমি আমাকে শুধু ঠুকে ঠুকে শুনিয়ে গেছ, আমাকে বিয়ে করতে হয়েছে বলে তুমি বিরক্ত?"
- "ওটাই ঝগড়া। আমার ভালো লাগছিল না, তার মধ্যে তুমি একটু আমাকে বুঝবে, একটু ভালো করে কথা বলবে, না সারাদিন শোনাচ্ছ, আমার জন্য সবকিছু ছাড়তে হয়েছে। কেন ছাড়লে?"
- "ছেড়ে ভুল করেছি। তুমিও ভুল করেছ। এবার ভুল শুধরে বাড়ি ফিরে যাও।"
ঘর জুড়ে শুধু স্তব্ধতা ! দুজনেই চুপ করে বসে থাকে খানিকক্ষণ। শেষে যুগল বোধহয় বোঝে, লিলি কতটা বিরক্ত, অসহিষ্ণু হয়ে গেছে এভাবে থাকতে থাকতে। ইচ্ছে না থাকলেও নিজেকেই আবার প্রশ্ন করে, এই লিলিকেই কি ভালোবাসত? একেই কি বিয়ে করেছিল? ও এমন হয়ে গেল কবে? যুগলকে যদি ওর বাড়ির লোক অপমান করে, সেই ভয়ে বাড়িতে দুজনের সম্পর্কের কথা জানায়নি সেদিন। আর আজ যখন ওকে একটাই কথা বলছে, চলে যাও, তার মানে বাড়ি থেকে নিয়ে এসে ও ভালো রাখেনি লিলিকে।
এটা ঠিক, এখন বিয়ে, সংসার, এসবের দায়িত্ব নিতে ও তৈরি ছিল না। সব কি হিসেবমতো হয়? একবার বিয়ে হয়ে গেলে মা, ভাবিজিরা লিলিকে দেখতে চাইবে, কথা বলবে ভেবেছিল ও। কেউ জানতেই চাইল না ওর কথা। যুগলকে ডাকিয়েছিল বড়ে ভাইয়া। ও খুশি খুশি গেছিল, সব ঠিক হবে বলে। ওরা বলল, লিলিকে ছেড়ে দিতে। রোজ ঝামেলা হচ্ছিল লিলির সঙ্গে। এখন বুঝতে পারছে, বোকামি হয়েছে, লিলিকে ভয় দেখাতে বলেছিল পাপাজি কি বলেছে।
উলটো ফল হয়েছিল, লিলি আর একদিনও কথাই বলেনি ওর সঙ্গে। তার মধ্যে ওদের বাড়িতে এসে রনি টের পেয়েছিল, ঝামেলা হচ্ছে। ওকে বকাবকি করেছিল, লিলিকে কেন কষ্ট দিচ্ছে? অভিযুক্ত হতে কার ভালো লাগে? রনিকেও ভালো লাগেনি, এই নিয়ে কথা বলতে হলে বাড়িতে আসতে বারণ করেছিল। লিলি আরও রেগে গেছিল।
লিলির রাগ ওকেই ভাঙাতে হবে, লিলিকে বলতে হবে, আলাদা হওয়ার জন্য নয়, তিক্ততা মেটানোর জন্যই ডিভোর্সের ভয় দেখিয়েছিল, লিলির এ্যাটেনশন চেয়েছিল বরাবরের মতো।
উঠে এসে লিলির কাঁধে একটা হাত রেখে দাঁড়িয়ে বলে, "মন থেকে চলে যেতে বলছ? পারছ আজ এমন ব্যবহার করতে?"
- "আমার ব্যবহার খারাপ বলেই তো ডিভোর্স হচ্ছে। কোর্টে বলবে, আমি কেমন মেয়ে। আর বলছি তো, তোমরা ডিভোর্সের জন্য এগোচ্ছ শুনে রনিদা ওর বন্ধুর চেনা কোন ব্যারিস্টারের সঙ্গে দেখা করেছে, কথা বলেছে। উনি ওকে আশ্বাস দিয়েছেন, আমি অনেক টাকাপয়সা পাব। আমার কিছু চাই না। তুমি কেস করো, আমি সব ছেড়ে দেব। কথার কথা না, কাল কেস করো, কাল প্রমাণ হয়ে যাবে।" যুগলের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ কানে আসে, লিলি নিজের উত্তর দিয়ে দিয়েছে ওকে।
- "আমি কোর্ট, কেস, টাকা, প্রপার্টি, কিছুর কথা বলছি না। আমাকে মন থেকে যেতে বলছ কিনা জানতে চাই। আমাকে ছেড়ে দেবে কিনা জানতে চাই।" ওর দুকাঁধ ধরে নিজের মুখোমুখি ঘোরায় যুগল।
- "কি লাভ? চলে তুমি যাবেই। আমি কেঁদে কেঁদে বলব, যেওনা, আমার দিকে না তাকিয়ে তুমি চলে যাবে, এই স্যাটিসফ্যাকশন চাইছ? বেশ, তাও বলে দিচ্ছি, যেও না।" লিলি মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
দুহাতে লিলির মুখ ধরে ওর কপালে চুমু খায় যুগল, আচমকা, লিলি কেঁপে ওঠে, কতদিন পর যুগল নরম গলায় কথা বলছে, ওকে দোষারোপ না করে প্রশ্ন করছে এই প্রথম বুঝতে পারে।
- "ঠিক বলেছ। ডিভোর্স হোক একবারও চাইনি। তবে তুমি আমাকে দোষ না দিয়ে কান্না করে কথা বলো, ভালোবাসো, এটা চেয়েছিলাম। তুমি যে আমার পার্টনার, সবদিকে, ভুলে গেছিলাম। তুমিও বাড়ি ছেড়েছ, তুমিও আমার মতো কষ্ট করে নোকরি করছ, উলটে ঘরের কাজ করছ। একটু কিছু খতম হয়ে গেলে অড টাইমে কিনতে বললে, চা করে খেতে বললে মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছিল।" লিলির কাঁধে হাত রেখে যুগল বলে যাচ্ছে, লিলি প্রথমে ছটফট করছিল ওর হাত ছাড়াতে, এখন শান্ত হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
- "মাকে, চাচিজিদের, ভাবিজিদের তাই দেখেছি। কি কি ঘরের কাজ করতে হবে, মেশিন কা মাফিক করে যায়, ভুলচুক হলেই সবাই বকে। মেল মেম্বাররাও, ফিমেল মেম্বাররাও। মাকে দাদিজি বকত, মা ভাবিজিদের বকে। তোমাকেও আমি বকেছি। তুমি যে বাইরেও কাজ করো, সিনেমায় যাও না, আমার চোখেই পড়েনি। বাড়িতে একটু কমফোর্ট বাদ মে, লিখা পড়ার টাইম চাই, মনে ছিল না। তাই আমাকে চলে যেতে বলছ?"
লিলির রাগ পড়ে আসছিল যুগলের এত মিষ্টি কথায়, না বলতেই যাচ্ছিল, শেষ মুহূর্তে মনে পড়ে, যুগল কি ব্যবহার করেছে ওর সঙ্গে, আর রনিদা এসব টাকাপয়সার চাপ না দিলে এত তাড়াতাড়ি সব বদলাত না। ওর হাত সরিয়ে উঠে জানালার সামনে চলে যায় লিলি, "তুমি আমার সঙ্গে থাকতে পারবে না। নিজেই তো বলছ, তুমি অন্যভাবে বড় হয়েছ। এখনও বাড়ি ফিরে যাও। ভালোভাবে থাকতে পারবে।"
- "রাগটা কিছুতেই কমবে না?" যুগল ওকে জড়িয়ে ধরেছে।
- "ছাড়ো তুমি, রাস্তা থেকে দেখা যাচ্ছে।" লিলি ওর হাত ছাড়াতে চায়।
- "রাগটা কমবে না?" যুগলের ছাড়ার কোনো লক্ষণ নেই।
- "কি করছ বলোতো? তুমি রাস্তার লোককে দেখাতে চাইছ, আমরা খুব হ্যাপি কাপল? বা তুমি আমাকে ভালোবাসো, আমি ভালোবাসি না? ঠিক তাই। তোমার সঙ্গে আমিই থাকতে চাই না। হয়েছে? এবার ছাড়ো।" লিলি খেপে ওঠে।
যুগল ওকে ছেড়ে দিয়ে জানালার পর্দাটা টেনে দেয় ভালো করে। ফিরে দেখে লিলি রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকেছে, ওর সঙ্গে কথা বলবে না। লিলি সকালের রান্না তরকারি গরম করে, রুটি করে। যুগল চুপ করে রান্নাঘরে একপাশে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ও এসব কাজ পারে না। তাই লিলিকে যে তোমার করতে হবে না, আজ আমি খাবার বানাচ্ছি বলে পটাবে, তাও পারবে না বুঝে গেছে।
লিলির রুটি বানানো শেষের পর্যায়ে দেখেই চটপট গিয়ে নিজেদের ঘরের একমাত্র ছোট টেবিলটার উপর থেকে সব বই খাতা কাগজ সরিয়ে খাটের উপর রাখে যুগল। দুজনের জলের গ্লাসদুটো নিতে রান্নাঘরে এসেছে, লিলি ততক্ষণে গেছে টেবিল পরিষ্কার করতে। যুগল গিয়ে গ্লাসদুটো টেবিলে রেখে লিলিকে জোর করে একটা চেয়ার টেনে বসিয়ে দেয়, "ধীরে ধীরে খানা পাকানা শিখে যাব। আজ আমি খেতে দেব।"
- "যুগল....."
- "জানি, খাবার নষ্ট করব। তাও আমিই দেব। তুমি বসে বসে খাবে।"
- "তুমি ঝগড়া করো, ঠিক আছে, ন্যাকামি মেরো না।" লিলি উঠে পড়ে।
- "আচ্ছা বাবা আচ্ছা, ন্যাকামি। ধরে নাও, চলে যাব তাই লাস্টটাইম। আমি খেতে দেব, তুমি খাবে, নাহলে আমি খাব না।" লিলির হাত ছেড়ে গ্লাসে জল ঢালছে যুগল। লিলি বসে বসে গজগজ করে, ঢং ন্যাকামি আদিখ্যেতা।
যুগল ওদিকে থালা আনে, রুটি দেয়। দুরকম তরকারি রান্না করেছিল লিলি। সেগুলো এনে এদিক ওদিক তাকায়, চামচের খোঁজে। লিলি উঠে আসে, যুগল চেঁচাতে থাকে, ও চুপচাপ দুটো বড় চামচ এনে দুই তরকারির বাটিতে দিয়ে বসে পড়ে।
- "দ্যাটস লাইক এ গুড গার্ল। মেরি পরী।" লিলি বসে পড়েছে দেখে একগাল হেসে যুগল বলে। লিলির আরও মনখারাপ হয়ে যায়। কতদিন পরে যুগল হাসল, তাও এত পাঁপড় বেলার জন্য। আসলে তো থাকবে না ওর সঙ্গে।
ছোট ছোট বাটিতে দুজনের খাবার দিয়ে যুগল লিলির সামনে এগিয়ে দেয়, "খুব খারাপ হয়নি। ধীরে ধীরে সব শিখে নেব।"
- "কি দরকার? তোমার পরের বৌ তোমার মায়ের মতো হবে, তোমার মনের মতো হবে।" লিলি থালাটা টেনে নেয়।
যুগল ওর দিকে তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ। লিলি খেতে শুরু করেছে, যুগলকে পাত্তা দেয় না দেখাতেও। যুগল বলে, "এই স্টিলের থালা বাটিতে আমাদের বাড়িতে কেউ খায় না। তোমাকে এভাবে খেতে দেখলে নিজেকে ইউজলেস মনে হয়। সামনের মাসে আমি একটা ছোট ডিনার সেট কিনবই। মিলি এলে কিসে খাবে? তুমি একদম খিচখিচ করবে না খরচ নিয়ে।"
এই ডিনার সেট কেনা নিয়ে আগেও তর্ক হয়েছিল। দুজনেই অন্যের কথা মানেনি। কারণ যুগল বলেছিল, ও এভাবে খেতে পারে না। আর লিলি জেদ করেছিল, অত টাকা যখন ওদের নেই, তখন খেতে হবে। এখন তাই সামনের মাসেও এই খেলাঘরের সংসার থাকবে, যুগল ওর জন্য, বাড়িতে আসা অতিথির জন্য কেনাকাটা করবে শুনে লিলি আচমকা কেঁদে ফেলে। যুগল লিলির চেয়ারের পাশে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে, "আরে পাগলী, ঝগড়া হল মানে সব খতম হয়ে গেল? তোমাকে আমি ডিভোর্স দেব? আমার একটা কথা না শুনলে এত ঝামেলা করি, তুমি আলাদা হলে আমার কথা কে শুনবে?"
চলবে
পাঠকদের কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। বেশ কিছুদিন ধরে আপনারা আমার লেখা পড়ছেন। অনেকেই ভালমন্দ মন্তব্য করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আমি ডিজিটাল ব্যাপারে একটু আনাড়ি। তাই এই অ্যাপে আপনাদের মন্তব্য কিভাবে খুঁজে পাব, এখনও বুঝতে পারিনি। আমি মেইল করেছিলাম, কোনো উত্তর পাইনি। যদি আমার মেসেঞ্জারে কেউ আমাকে একটু জানিয়ে দেন, কিভাবে আপনাদের মন্তব্য পড়ব ও উত্তর দেব, খুব উপকৃত হব। আগাম ধন্যবাদ জানাই।