ঝরাপাতা
পর্ব - ২
💙🌿💙🌿💙🌿💙
পিউর বুদ্ধিতে গোপার সঙ্গে কথা বলতে যাওয়ার আগে এক মুহূর্তের একটা দ্বিধা কাজ করে মণিকার মনে। যদি গোপারা রাজি হয়, ওরাও বেশি সময় নেবে না। এক দুদিন সবাই আলোচনা করে হ্যাঁ বলবে। তার মানে, নিজের দিকের সব আত্মীয়দের একেবারে বিয়ে ঠিক হয়েছে খবর দিতে হবে। সেটা কি ঠিক হবে?
বনির বিয়ের সময় দুই ননদের মুখ হাঁড়ি হয়ে গেছিল। সব ব্যাপারেই বলেছিল, কই আগে তো বলোনি? যদিও বিয়ের দু তিন বছর আগে থেকেই সবাই বুঝে গেছিল পিউ বাড়ির বৌ হবে। মণিকাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলে একগাল হেসে বলত, সে যদি হয়, তাহলে আমার সবচেয়ে আনন্দ হবে।
তারপর যখন পদে পদে প্রতিটি খুঁটিনাটি নাকি জানিয়ে করা উচিত ছিল এমন হাবভাব দেখালো ননদরা, এবার তো আরও সুযোগ ! এক দাদা আর এক ভাই আছে, তাদের বৌরা, কাউকেই না জানিয়ে কথাবার্তা সেরে ফেলা হবে?
সঙ্গে সঙ্গে এও ভাবে, কথা যাতে না বাড়ে, তাই পিউ যদি নিজের মাকে জানাতে না চায়, মণিকার কাকে ভয়? ভগবানের কৃপায় ওরা হ্যাঁ বললে তখন সবাইকে ডাকা হবে, বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে সবাই থাকবে।
দুরুদুরু বুকে গোপার কাছে যাওয়ার সময় মণিকার হাসিই পেয়ে যায়। উপযুক্ত ছেলের বিয়ের প্রস্তাব দিতে ভয়ে ভয়ে যেতে হচ্ছে, অথচ কয়েক বছর আগেও ছেলের বাবা মায়ের কি দাপট ছিল। মেয়ে দেখা ব্যাপারটা কত সুন্দর দুটো পরিবারের মানুষের পরিচয় বন্ধুত্বের ধাপ হতে পারত। তা না কুৎসিত একটা প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মণিকার মাকে নাকি আচমকা লম্বা বেণী ধরে টেনে চুল আসল না নকল পরীক্ষা করেছিলেন ওর পিসি। অথচ সেই পিসি মায়ের চেয়ে ছোট, তখনও অবিবাহিত। সংসার সমুদ্রে মানুষকে এভাবে অসম্মান করা শিখত মেয়েরা, তা নয়। একটি মেয়েকে মানুষের মর্যাদা দেওয়ার মতো সুস্থ মানসিকতা মেয়েদের তৈরিই করা হতো না। সেইসব মেয়েদের জন্য কষ্ট হয় মণিকার।
তবে গোপার কাছে গিয়ে একটু কিন্তু কিন্তু করে কথাটা পাড়ার পর মন থেকে সব চিন্তা মুছে গেল। গোপা যেন হাতে চাঁদ পেল। ওর উচ্ছ্বাস দেখে এতক্ষণে মণিকা একটু আরাম করে বসল, মিটিমিটি হাসতে থাকল।
গোপা এদিকে বলে যাচ্ছে, "ও মণিকাদি, তুমি যে আমাকে কি নিশ্চিন্ত করলে ! আজকাল কাগজে, টিভিতে যা সব খবর দেখি, মেয়ের বিয়ের কথা তুলতেই ভয় করে। না দিলেও নয়। জোরশোর করে খোঁজখবর না করে, মেয়ের বয়েস বেড়ে যাচ্ছে কেবল। এবার কিছু না করলেই নয়। তবে সত্যি বলছি, তোমার মতোই একে ওকে বলছিলাম, ভাল ছেলে থাকলে খবর দিতে, ম্যাট্রিমনি সাইটে দিচ্ছি বটে, বুক ঢিপঢিপ করছিল কপালে কি আছে কে জানে।"
গোপার বাক্যস্রোত থামিয়ে মণিকা বলে, "এত লাফিও না। লিলির সঙ্গে আগে কথা বলো, দাদাকে বলো। ওরা যা বলবে, তেমনি হবে।"
- "ওরা আবার কি বলবে গো? তোমার দেওর কি না বলবে? আর লিলি যেই শুনবে পিউর সঙ্গে সারাজীবন আড্ডা দিতে পারবে, আমার থেকেও বেশি নাচবে দেখো।"
বাড়ির সবার সঙ্গে কথা বলে ধীরেসুস্থে সিদ্ধান্ত নিতে বলে মণিকা ফিরে আসে। অবশ্য গোপা ফ্রিজ খুলে মিষ্টি খাইয়ে তবেই ছেড়েছে।
এ বাড়িতে পিউ বসে ছিল উত্তেজনা চেপে। মণিকা আশ্বাস দিল, "তোর ভাইয়ের বিয়ে লাগল বলে।"
বনি বেচারা আজ বাড়ি ফিরে চা আর পায় না। টুকাইকে গল্প শোনাচ্ছে তার ঠাম, মাম গিয়ে পাকড়েছে কাকাইকে। রনিকে এত ভাল মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে দেওয়ার ঘটক বিদায়ের যা লিস্ট দিয়েছে পিউ, তাতে দশখানা বিয়ে হয়ে যাবে। রনি যত হাসছে, পিউ খেপে খেপে উঠছে। বনিও নিজের বৌয়ের দলে যোগ দিতে রনি কোথায় পালাবে ভেবে পেল না।
🌿🍁🌿🍁🌿🍁🌿
এর ঠিক উলটো ছবি লিলির বাড়ির। সমর আর লিলি আগে পরে অফিস থেকে ঢুকতেই চায়ের জল চড়িয়েই গোপা সব কথা বলে ফেলে। আনন্দ চেপে রাখা আর সম্ভব হচ্ছিল না ওর পক্ষে। একবার তো সমরকে ফোন করে বলবে ভেবেছিল। অফিস থেকে বেরোনোর সময় হয়ে যাচ্ছে, তখন সব গুছিয়ে বেরোতে হবে, আর রাস্তাতেও এসব কথা বলা যায় না বলে যেটুকু ধৈর্য্য ধরে ছিল। মিলি কলেজ থেকে ফিরতে ওকে বলে একটু শান্তি পেয়েছে।
সমর খুশিতে লাফিয়ে ওঠে, কিন্তু ব্যাজার মুখে লিলি বলে, ওর মত নেই। বাবা মা দুজনেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
গোপাই আগে সামলে নেয়, কড়া গলায় বলে, "মত নেই বললে তো হবে না। এমন জায়গায় বিয়েতে তোর কেন মত নেই আমি জানতে চাই।"
- "দেখো মা, আমি কম্পিউটারের কোর্সটা গ্র্যাজুয়েশনের পাশাপাশি করেছি বলে চাকরিটা পেয়ে গেছি। সেটা বাবাও বলেছিল। এখন এমবিএ করছি চাকরির সঙ্গে। চাকরিটা তেমন না, তবে এক্সপেরিয়েন্স তো হচ্ছে। তাই কোনোটাই ছাড়তে পারব না। তুমি মামা মামীর বুদ্ধিতে নেচে উঠলে বিয়ের জন্য। আমাকে বোঝালে খোঁজখবর করতে এক দু বছর আরও লাগবে। তাই চুপ ছিলাম।"
- "এক দু বছর ছাড়। কারো কারো কতদিন কেটে যায়, কিছুতেই বিয়ের ঠিক হয় না জানিস? আমাদের কপাল ভাল, তাই এমন সম্বন্ধ বাড়ি বয়ে এসেছে।"
- "বুঝেশুনে কথা বলো মা। কোন যুগে পড়ে আছ? আমার যোগ্যতা কিসে কম? মণিকা জেঠিমা সেটা তোমার চেয়ে ভাল জানে। তাই ঐ আঁচলের ছেলেকে আমাদের ফ্যামিলির সঙ্গে ভাবের দোহাই দিয়ে আমার ঘাড়ে চাপাতে এসেছে।"
এবার সমর হাল ধরে, "এসব কি বলছিস? মায়ের আঁচলের ছেলে ওরা কেউ নয়। রনি নেট স্লেট দুটোতেই কত ভাল রেজাল্ট করেছে সবাই জানে। কলেজে ঢুকতে না ঢুকতে ডিস্ট্রিক্ট ইউনিভার্সিটি ওপেন হতেই সেখানে একবার ইন্টারভিউ দিয়েই এখন ইউনিভার্সিটির লেকচারার। এই বয়সেই কজন এতদূর যায়? আর কেমন ছেলে সেটা তোরা আরও বেশি জানিস। বনির তাও একটা বান্ধবী ছিল, প্রেম করেছে, রনির তাও না।''
রাগে গা জ্বলছে লিলির। একটা প্রেমও যদি করতে পারত রনিদা ! তাহলে ওর উপর বিপদটা আসত না। মুখ গোমড়া করে থাকে, কিন্তু বলার মতো কোনো পয়েন্ট নেই, এটা বোঝে।
নিজের মাথায় আগুন জ্বলছে, তার উপর বাড়ির তিনটে লোক ওর দুর্দশাকে সৌভাগ্য বলে চালাতে চাইছে। শোওয়ার সময় বোন এসে শুধু বলেছে, "ওহ দিদি, তোর রনিদার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে, আমি ভাবতেই পারছি না।"
লিলি খ্যাঁক করে উঠল, "ভাবিসও না। রনিদার সঙ্গে বিয়ে হওয়া মোটেই ভাল না যে সেটা নিয়ে গদগদ হয়ে বসে বসে ভাববি।"
- "বা রে, ভাবব না কেন? একশোবার ভাবব। রনিদার মতো ছেলে হয় নাকি?"
- "তোর মনে হচ্ছে তো রনিদার মতো ছেলে হয় না? তুই রনিদাকে বিয়ে করে নে। তুইও খুশ, আমিও খুশ, হয়েছে?" বালিশটা উলটে শুয়ে পড়ে লিলি।
- "যত বাজে কথা।" বলে দিদির গলা জড়িয়ে ধরে মিলিও খুশি খুশি ঘুমিয়ে পড়ে।
হু হু করে দিনগুলো আনন্দের ভেলায় বয়ে চলে। দুমাস পরেই তিথি নক্ষত্র মিলিয়ে একটা খুব ভাল দিন পাওয়া গেছে। সবাই তাতেই মত দিয়েছে।
সবাই বলতে অবশ্য রনির পিসিরা আসেনি। তাদের বক্তব্য, এই সম্পর্ক আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। ওদের বাইরের লোকের মতো এখন জানানো হচ্ছে, তাই বিয়ে বয়কট করেছে। এবার এত বছর ধরে অতিষ্ঠ মণিকাও শক্ত হয়ে আছে। মণিকার দাদা আর ভাইয়ের পরিবার খুব খুশি, খুশি লিলির মামার বাড়ি, একমাত্র কাকার পরিবার। আর পিউর বাবা মা তো আছেই।
এরা পালা করে নানা বুদ্ধি দিয়েছে, কেনাকাটায় সঙ্গ দিয়েছে, নিজেরাও বর কণের জন্য উপহার কিনেছে। অবশেষে আজ বিয়ের দিন।
চলবে