ঝরাপাতা
পর্ব - ১৬
🌷🌿🌷🌿🌷🌿🌷
দোকানে অনেকক্ষণ শাড়ি নিয়ে নাড়াচাড়া করে শেষে আর পেরে ওঠে না মণিকা। পিউকে বলে বসে, "হ্যাঁ রে, আমরা যদি মিলিকে একটা শাড়ি দিই, ওর চিকিৎসায় কি কোনো খারাপ এফেক্ট হতে পারে?"
- "কি জানি মামনি ! ওদের জামাকাপড় সেভাবে দিইনি কখনো। তবে অনেক সাজগোজের জিনিস, কসমেটিকস, ইমিটেশন গয়না তো আমি কিনে দিতাম। পুজোয় এইসব, জন্মদিনে বই গিফট দিতাম। না দিলেই কি ভালো হবে? তার চেয়ে কিছু কিনে দিই, বলো?"
- "তুই তাহলে ওদের পছন্দমতো সাজগোজের জিনিস কিনে নে। আর, বলছিলাম কি একটা শাড়ি যদি আমি দিই, ছেলেরা রাগ করবে?"
- "ছেলেরা বলতে, তোমার বনি বলবে, মায়া বাড়াচ্ছি। আর ছোটজন মিলির নামে কিছুই বলবে না।"
- "সত্যিই রে। বড্ড মায়া হয়। আমার ছেলেটা যদি বন্ধুর বাড়ি না গিয়ে একবার ওর দাদাকে কথাগুলো বলত ! তাহলে আমরা তখনই মিলির সঙ্গে ওকে কথা বলতে দিতাম। সেখানেই সব মিটে যেত।"
- "থাক মামনি, কি হলে কি হত ভেবে লাভ নেই। বনি তখন ক্যাটারারের লোকের সঙ্গে ছিল, রনি ওর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পায়নি। বন্ধুরাও ঠাট্টা করছিল। এমন একটা কান্ড হবে আন্দাজ করতে পারেনি। সুমিত তো ক্ষমাও চেয়েছে বনির কাছে। তুমি বরং একটা শাড়ি কেনো মিলির জন্য।"
- "না শাড়ি না। একটা সালোয়ার সেট দিই ভালো দেখে। হঠাৎ শাড়ি মিলির কেমন কেমন লাগতে পারে। ঐ যে ওধারে গোলাপি রঙের সেটটা দেখত।"
সন্ধ্যায় ছেলেরা ফেরার পর দুজনের চোখে চোখে ইশারা চলছে, কে বলবে। শেষে বনি মা আর বৌয়ের হালচাল দেখে নিজেই বলল, "কিছু কি হয়েছে? মিলিকে নিয়ে?তোমরা দুজন যেন কেমন এ ওকে ঠেলাঠেলি করছ। কিছু হয়ে থাকলে বলে ফেলো। নাহয় আমি ঘরে যাচ্ছি। পিউ একটু চা নিয়ে এসো তো।" যদি মিলির কোনো কথা হয়, রনির সামনে ওরা না বলতে চায় ভেবে বনি উঠে পড়ে। এদিকে মিলির নাম শুনেই টুকাইয়ের সঙ্গে বল ছোঁড়ার খেলা বন্ধ করে ফিরে তাকিয়েছে রনি।
- "না না উঠিস না। একটু বোস। একটা জিনিস দেখাব। দুজনেই দেখ, তোরা না বললে আর করব না। পিউ নিয়ে আয়।" মণিকা ছেলেকে থামায়।
পিউ মিলির জন্য যা কেনাকাটা করেছে, এনে দেখায়, সেগুলো যে মিলির জন্য দুরুদুরু বুকে সেকথা বলে দুজনে। এরা সত্যিই ওদের উত্তরের অপেক্ষা করছে, বারণ করলে দেবে না বুঝে, বনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে, "কি বলি বলোতো? পিউ বলছে, আগেও এসব সাজগোজের জিনিস দিত। না দিলেও মিলি ভাববে, লিলির এখানে বিয়ে হয়নি বলে আমরা দিলাম না। আবার তোমার ইচ্ছে, তা হিসেবমতো পিউকে দিলে তোমার মিলিকেও দেওয়ার কথা, সেটাই বা বারণ করি কি করে?"
- "ভয় করে রে। মেয়েটার যেন আর কোনো ক্ষতি না হয়।" মণিকার চোখে জল টলমল করছে।
- "ক্ষতি আর কি হবে? সমস্ত কথা মনে পড়তে পারে। তা একদিন তো মনে পড়বেই। এবার যখন ইচ্ছে হয়েছে, মেয়েটার নাম করে কিনেছ, দিয়ে দাও। মনে পড়লে বোধহয় আর কিছু নেবে না আমাদের থেকে।" যেদিন থেকে শুনেছে, বিয়ের কথা মনে পড়লে মিলি হয়তো সম্পর্কটাকে মন থেকে মেনে নেবে না, আইনী বিচ্ছেদ হবে, বনির খুব কষ্ট হয়। ছোট ছোট দুটো মেয়ে, পিউর সঙ্গে কত গল্প আড্ডা ছিল। সামনাসামনি বাড়ি, তাদের সঙ্গে এমন খারাপ একটা সম্পর্ক হয়ে যাবে !
পিউ বলে, "রনি এগুলো কিন্তু আমি আর মামনি দিচ্ছি। তোমার কোনো ব্যাপার না। মানে, তোমাকে এর মধ্যে ইনভলভ হতেই হবে আমরা সেসব বলছি না। আর তোমার আপত্তি থাকলে বলো, জামাটা দেব না।"
- "আমার মত শুনতে চাও তুমি? এতগুলো দিন ধরে একবার ডেকে জিজ্ঞেস করেছ? একবার ভাই বলে ডেকেছ? এখনও এটাই বিশ্বাস কর যে আমি মিলির খারাপ হোক তাই চাই। তাহলে আজ জিজ্ঞেস করছ কেন?" আচমকা রনির অভিমান পিউকে অপ্রস্তুত করে দেয়।
- "আমি মোটেই এসব ভাবিনি ভাই।" পিউ তাড়াতাড়ি ম্যানেজ করতে এগোয়।
- "আমাকে একদম ভাই বলে ডাকবে না তুমি ! কে তোমার ভাই? তোমার ভাই মরে গেছে ! রনির সঙ্গে তোমার কোনো কথা বলতে হবে না।" দুমদাম করে উঠে চলে যায় রনি।
মণিকা ম্লান একটু হেসে বলে, "চিরকাল তুই আহ্লাদ দিয়েছিস। এখন তুই রাগ করে আছিস, ওর ভালো লাগছে না। বাদ দে। তোর ইচ্ছে না করলে ওর সঙ্গে কথা বলবি না। আমি বুঝিয়ে বলব'খন ওকে।"
- "ও আচ্ছা, একদিন বকেছিলাম বলে, তোমার ছেলে আজ এতবড় কথা বলে গেল আমাকে ! সেটা কিছু না ! খালি আমি রাগ করে আছি !" পিউও ফোঁপাতে শুরু করেছে।
টুকাই প্রথম চোটে হতবাক হয়ে গেছিল। এখন মাকে কাঁদতে দেখে তারও ভ্যাঁ শুরু। বাবাই তাড়াতাড়ি কোলে নিয়ে কাঁদে না বলতেই প্রশ্ন, "কাকাই কি রাগ করেছে? মামকে বকু করেছে?"
- "হ্যাঁ, তোমার কাকাই আর মাম তো তোমার থেকে অল্প এট্টুখানি বড় খালি, তাই এসব হয় ওদের। তুমি তো খুব বুদ্ধিমান। তুমি ঠামের সঙ্গে বসে খেলোতো। আমি কাকাইকে ডেকে আনি।" মায়ের কাছে ছেলেকে বসিয়ে দিয়ে পিউর হাত ধরে রনির ঘরে নিয়ে আসে বনি।
ঘরে নেই, ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সি *গা *রে *ট খাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে। পিউ দরজায় দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে, ঘরে ঢুকবে না। বনি এবার বৌয়ের হাত ছেড়ে ভাইয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। রনি সঙ্গে সঙ্গে উলটোদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। বনি গলা জড়িয়ে ধরে বলে, "কি ছেলেমানুষি হচ্ছে ভাই? ওরকম করে বলে? কত খারাপ একটা সিচুয়েশনে পড়ে গেছি আমরা, তার মধ্যে এসব খারাপ কথা বলছিস? দেখলি তো সংসারে কখন কি হবে কেউ বলতে পারে না। আয় ঘরে আয়। রাস্তা থেকে লোকে দেখবে।"
রনি গোঁজ হয়ে থাকে, "তুই নিচে যা। আমি একটু একা থাকব।"
- "ও আচ্ছা ! তুই একা থাকবি, তাতেই তোর মুড ভালো হয়ে যাবে ! আর পিউ কাঁদছে, তোর তাতে খারাপ লাগছে না?"
- "জানিস তো আমার জন্য সবাই খারাপ আছে? তাও আমার সঙ্গে কথা বলিস কেন?"
- "কে বলেছে তোর জন্য সবাই খারাপ আছে? মিলি ভালো হয়ে যাবে দেখবি। আর কেউ তোর উপর রাগ করে থাকবে না। আচ্ছা, আমরা নাহয় তোর নিজের লোক। রাগ করলেও তোকে ভালোবাসি। ওরা? তুই যার খোঁজ আনলি, সেই ডাক্তারকেই তো দেখানো হচ্ছে। তোর উপর রাগ থাকলে, তোর জন্য সব খারাপ হয়েছে ভাবলে ওরা রাজি হতো? চল না ঘরে চল।" টানতে টানতে ভাইকে নিয়ে আসে বনি।
রনি এসে টেবিলের সামনে চেয়ারটায় বসে আছে, সি *গা *রে *টা ফেলে দিয়েছে। বনি পিউকে বলে, "ঘরে ঢুকবে না এরকম টেনে টেনে আনতে হবে?"
পিউকে ওভাবে বলে ফেলে রনির আরও কষ্ট হচ্ছিল। এখন মুখ তুলে বলে, "আমার ঘর বলে আসবে না? মাপ চাইলেও না?"
পিউ ঘরে ঢুকে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে, "তুমি কেন মাপ চাইবে? আমার অন্যায় হয়েছিল, আমি বকেছিলাম, আমি মাপ চাইছি, সরি।"
চলবে