“ছায়ার চোখ, রাতের দাবি”
রাতটা অদ্ভুত নিস্তব্ধ।
মানুষ ঘুমিয়েছে—
কিন্তু ছায়াগুলো জেগে আছে।
মায়া ইরাকে ধরে বাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দিল।
দরজার কপাট লাগিয়েই
সে পেছনে হেলে দাঁড়াল—
মুখে এমন দুঃশ্চিন্তা,
যেন ভেতরে ঝড় চলছে।
ইরা সামনের টেবিলের আলো জ্বালিয়ে বলল—
— “মায়া, বসো।”
মায়া বসল না।
দেয়ালে হাত রেখে মাথা নিচু করে রইল।
তার নিশ্বাস অদ্ভুত তীব্র—
একদম রাতের-মায়ার মতো নয়,
কিন্তু দিনের-মায়ার মতোও না।
মধ্যবর্তী এক রূপ।
অধিকার আর ভয়ের মাঝামাঝি।
ইরা কাছে গিয়ে বলল—
— “তুমি ভয় পেয়েছ?”
মায়া মাথা নাড়ল—
— “ভয় পাইনি।
তোর জন্য রেগে আছি।”
ইরা অবাক—
— “আমার জন্য রেগে আছো?”
মায়া চোখ তুলে তাকাল।
চোখে যেন প্রচণ্ড ঝড় জমে আছে।
— “ও যেই ছায়াটা…
ও তোকে দেখছিল, ইরা।”
তার গলা কেঁপে উঠল।
“আমি সহ্য করতে পারি না।”
ইরা চেষ্টা করল হালকা হাসতে—
— “এতে রাগ করলে চলবে নাকি!”
মায়া ধীরে এগিয়ে এসে ইরার হাত ধরে টানল।
তার গলা ভারী—
— “তুই বুঝিস না, ইরা…
রাতের আমি তোকে ‘নিজস্ব জিনিস’ ভাবে।
ওর কাছে তুই একধরনের আলো…
আর আলোকে ছায়া চুরি করতে চায়।”
ইরা কেঁপে উঠল।
সে দেখেছে—
মায়ার রাতের রূপ শুধু ভয় নয়,
একধরনের নিষিদ্ধ আকর্ষণ,
যেখানে সুরক্ষা আর হুমকি দুটোই আছে।
ইরা জিজ্ঞাসা করল—
— “ও ছায়াটা কে? রোহান?”
মায়া মাথা নেড়ে বলল—
— “না। রোহান হলে বুঝতাম।
এটা অন্য কেউ ছিল।
আর সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার…”
সে থামল এক মুহূর্ত।
— “…ও আমাকে দেখছিল না,
ও তোকে দেখছিল।”
ইরার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল।
---
১. ছায়ার নজর
মায়া ইরার হাত শক্ত করে ধরে—
যেন কেউ এসে তাকে ছিনিয়ে নেবে।
এমন করে মায়াকে আগে কখনো দেখেনি ইরা।
হঠাৎ মায়া বলল—
— “একটা জিনিস জানিস, ইরা?”
— “কি?”
মায়ার চোখ হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল।
— “রাতের আমি কারো সাথে শত্রুতা করে না…
কিন্তু তোকে যে আঘাত করতে চাইবে—
তার জন্য আমি শত্রু হয়ে যাই।”
ইরার গলা শুকিয়ে গেল।
— “মায়া… তুমি এমন কেন বলছো?”
মায়া ধীরে ইরার চিবুক ধরল।
তার ঠোঁটের কোণে হালকা তীক্ষ্ণ হাসি।
— “কারণ আমি জানি
ও ছায়া-মানুষটা আবার আসবে।”
ইরা থমকে গেল—
— “কিভাবে জানো?”
মায়া ফিসফিস করল—
— “কারণ ওর চোখ বলছিল…
ও তোকে অধিকার করতে চায়।”
ইরা যেন বরফে ডুবে গেল।
ওকে কে অধিকার করতে চাইবে?
কেন?
ওর সঙ্গে কারো কি পরিচয় আছে?
কিন্তু ইরার মনে হচ্ছে—
ও ছায়া-মানুষটা
ইরার নাম জানত।
ইরাকে দেখেই গা-ঢাকা দিয়েছিল।
মায়ার হাত কাঁপছে।
এটা ভয় নয়…
প্রচণ্ড রাগ।
—
ইরা তার গাল ছুঁয়ে বলল—
— “মায়া, আমি ভয় পাচ্ছি না।
তুমি আছো।”
মায়া হালকা মাথা নাড়ল—
— “আমি আছি, ইরা।
কিন্তু তুমি জানো না—
রাতের আমি কোন পর্যায় পর্যন্ত যেতে পারি।
ও যদি তোকে স্পর্শও করে—
আমি তাকে… থামাবো না,
ধ্বংস করব।”
ইরা শিহরিত হলো।
এটা রোম্যান্স নয়।
এটা অন্ধকার প্রেম।
এটা দাবি।
এটা ভয়।
এটা আকর্ষণ।
---
২. মায়ার সত্যি—ট্রমার দরজা খুলল
ইরা শান্তভাবে বলল—
— “মায়া, আমাকে সত্যিটা বলো।
রোহান কেন বলল
তোমার রাতের রূপ ট্রমা?”
মায়া হঠাৎ চুপ করে গেল।
তার চোখে ভয়, লজ্জা আর অন্ধকারের মিশ্রণ।
— “আমি বলতে চাই না।”
ইরা তার হাত চেপে ধরল।
— “তুমি আমাকে বিশ্বাস করো।
আমি পালিয়ে যাব না।”
মায়া এতক্ষণ চুপ,
হঠাৎ নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠল।
অদ্ভুতভাবে সে বলতে শুরু করল—
কণ্ঠ কাঁপছে।
— “ইরা…
আমার রাতের রূপ জন্মগত না।
এটা তৈরি হয়েছে।
কারো জন্য।
এক ঘটনার জন্য।”
ইরা চুপ।
মায়া চোখ বন্ধ করল—
— “বয়স ১৪…
আমার ওপর কিছু হয়েছিল।
খুব খারাপ কিছু…”
ইরা শ্বাস আটকে গেল।
সে মায়ার হাত দুটো ধরে ফেলল—
— “থামতে চাইলে থামো।
আমি চাপ দেব না।”
মায়া মাথা নাড়ল—
— “আজ বলতেই হবে।
কারণ তোর জীবনে আমার রাতের রূপ ঢুকে গেছে।
তুই না জানলে চলবে না।”
ইরা নীরবে অপেক্ষা করল।
মায়া বলল—
— “সেদিন…
আমাকে কেউ অনুসরণ করত।
এক মাস ধরে।
আমি বুঝতাম না।
বাড়ির কাছে, রাস্তায়, স্কুলের সামনে।
একদিন রাতে…
বাড়িতে ঢোকার সময়—
ও আমাকে ধরে।”
ইরা চোখে জল এসে গেল।
মায়া বলল—
— “ওর মুখ, চোখ, হাসি…
সব ভুলে যেতে চাই।
কিন্তু রাত হলেই মনে পড়ে।
পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায়।
ওর ছায়া সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে।”
ইরা ভয়ে কেঁপে বলল—
— “তারপর…?”
মায়া ধীরে বলল—
— “আমি চিৎকার করেছিলাম।
কেউ শুনেনি।
কেউ দেখেনি।”
ইরা হঠাৎ মায়াকে জড়িয়ে ধরল।
মায়া নিঃশব্দে বলল—
— “সেদিন রাতে…
আমার ভেতর কিছু ভেঙে গেল।
কিন্তু অন্য কিছু জন্ম নিল—
যে রূপ তো দেখিস।
রাত নামলেই
আমি আর আমি থাকি না।
আমি হয়ে যাই—
কেউ আমাকে আঘাত করলে
তার শত্রু।”
ইরা চোখ মোছার চেষ্টা করে বলল—
— “এই রূপ তোমার দোষ নয়।
এটা তোমার বেঁচে থাকার যুদ্ধ।”
মায়া চোখ তুলল—
ভেজা, ভাঙা চোখ।
— “আর তুই…
তুই আমার শান্তি, ইরা।
দিনের আমি তোকে চাই ভালোবাসার জন্য—
আর রাতের আমি তোকে চাই বেঁচে থাকার জন্য।”
ইরার বুক ধড়ফড় করছে।
এত বড় সত্যি মায়া কখনো কাউকে বলেনি।
রোহান ছাড়া।
এটা মানে…
ইরার গুরুত্ব এখন ভয়ঙ্কর গভীর।
---
৩. রাতের অধিকার–প্রথম স্পর্শের জটিলতা
ইরা মায়ার গাল ছুঁয়ে বলল—
— “তুমি আমাকে ভালোবাসো, মায়া।”
মায়া ফিসফিস করল—
— “আমি তোর থেকে পালাতে চেয়েছিলাম।
কারণ আমি জানতাম
আমার রাতের রূপ তোকে পাগল করে দেবে…
অধিকার করে নেবে…
তোর জীবন দখল করবে।”
ইরা এগিয়ে এলো—
— “তুমি কি আমাকে দখল করতে চাও?”
মায়ার চোখ লালচে হয়ে উঠল।
তার কণ্ঠ গা-শিরশির করা—
— “চাই।
দিব্য চাই।
বিশ্বের সবকিছুর চেয়ে বেশি চাই।”
ইরার নিঃশ্বাস ভারী হলো।
হঠাৎ বিদ্যুতের মতো
মায়া ইরার হাত দুটো দেয়ালে ঠেকিয়ে দাঁড়াল—
একদম কাছে।
তার শ্বাস ইরার গলায় লেগে যাচ্ছে।
— “তুই বুঝিস না, ইরা…”
মায়া ফিসফিস করল।
“রাতের আমি তোকে যে স্পর্শ দিয়ে গেছে—
ওটা ‘ইচ্ছে করে’ দেয়নি।
ওটা ‘অধিকার’।”
ইরা গলায় কাঁপুনি নিয়ে বলল—
— “তোমার রাতের রূপ আমাকে কেন এতটা চায়?”
মায়া এত কাছে—
যেন দূরত্ব নেই।
— “কারণ তুই আলাদা।
তোর আলো…
তোর ভয়…
তোর কোমলতা…
তোর ভেতরের ক্ষত…
সবকিছু—
ওকে টানে।”
ইরার চোখ ভিজে উঠল।
— “তুমি আমাকে কষ্ট দেবে না?”
মায়া তার ঠোঁট ছুঁয়ে ফিসফিস করল—
— “দিব্য আমি না।
কিন্তু রাতের আমি…
তোকে ছাড়া থাকতে পারে না, ইরা।
ও তোর হৃদয় দখল করতে চায়।”
ইরার শরীর শিহরিত হলো।
হঠাৎ—
বাড়ির বাইরে
জোরে কোনো কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ।
দুটোই চমকে উঠল।
মায়া ফিসফিস করল—
— “ও এসেছে।”
---
৪. ছায়ার উপস্থিতি—বাড়ির বাইরে
মায়া ইরাকে নিজের পেছনে ঠেলে দাঁড়াল।
তার চোখ আবার লাল হচ্ছিল।
রাতের রূপ জেগে উঠছে।
— “মায়া! না!”
ইরা হাত ধরে বলল।
মায়া থামল না।
দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল—
হাত কপাটে,
শরীরারের সব মাংসপেশি শক্ত।
ইরা দেখতে পেল
দরজার নিচে
ছায়ার লম্বা আকার নড়ছে।
কেউ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
ধীরে হাঁটছে।
মাটিতে চাপা পায়ের শব্দ।
মায়া ফিসফিস করল—
— “আমি গন্ধ পাচ্ছি।”
তার গলা যেন পশুর মতো।
— “কে?!”
— “ওই ছায়া-মানুষটা ফিরে এসেছে।”
ইরা ভয়ে কেঁপে উঠল।
হঠাৎ—
দরজায় ধীরে ধীরে
নখের দাগ কাটা হলো।
চ্ছশশররর…
ইরার বুক ঠান্ডা হয়ে গেল।
ওটা মানুষ না—
নখ?
মায়ার চোখ সম্পূর্ণ লাল।
ঠোঁট কেঁপে উঠছে—
রাগে, ব্যথায়, হিংস্রতায়।
— “তোকে কেউ ছুঁতে পারবে না, ইরা।”
তার কণ্ঠ গর্জন।
ইরা পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরল—
— “মায়া! দরজা খুলো না!
ও কে তা না জেনে—”
মায়া বলল—
— “ও তোকে দেখে গেছে।
তোকে চাইছে।
আমি ওকে জীবিত রাখব না।”
ইরা চিৎকার করল—
— “মায়া! প্লিজ!
আমি চাই না তুমি আবার ভেঙে যাও!”
এই কথায়
মায়া থেমে গেল।
রাতের রূপ ধীরে ধীরে ম্লান হলো।
মায়া দরজা থেকে সরে দাঁড়াল।
তার নিশ্বাস কাঁপছে।
ইরা তাকে নিজের বুকে টেনে নিল।
— “আমি আছি।
আমি কোথাও যাচ্ছি না।”
মায়া চোখ বন্ধ করল—
যেন সব আগুন নিভে যাচ্ছে।
দরজার বাইরে
ছায়া-মানুষটা হাঁটছিল।
ধীরে…
ভয়ঙ্কর ছন্দে।
তার কণ্ঠ ভেসে এলো—
— “মায়া…
ইরা…
আমরা আবার দেখা হবে।”
ইরা চিৎকার করে উঠে দাঁড়াল—
— “তুমি কে?!”
আর কোনো উত্তর নেই।
শুধু হাওয়ার শব্দ।
মায়া পাশে দাঁড়িয়ে বলল—
— “ও ফিরে আসবে।
ও তোমার জন্য আসছে।”
---
৫. রাতের সিদ্ধান্ত
ইরা কাঁপছে— মায়া ধীরে তার মুখ ধরল।
— “ইরা…
ওকে থামাতে আমাকে রাতের রূপ চাই।”
ইরা ফিসফিস করল—
— “আমি তোমাকে হারাতে চাই না…”
মায়ার চোখ অদ্ভুত শান্ত হয়ে গেল।
— “তুই আমাকে হারাবি না।
দিনের আমি তোর জন্য থাকব—
কিন্তু রাতের আমি তোকে রক্ষা করবে।”
ইরা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল—
— “আর আমি?
আমি তো তোমাকে ভালোবাসি…
দু’টো রূপেই।”
মায়া অবাক হয়ে তাকাল।
— “তুই সত্যি…?”
ইরা হাসল।
— “হ্যাঁ।
দিনের তুমি আমার শান্তি।
রাতের তুমি আমার সুরক্ষা।”
মায়ার চোখ ভিজে উঠল।
সে ইরাকে আলতো জড়িয়ে ধরল।
— “তুই আমার।”
ইরা ফিসফিস করল—
— “হ্যাঁ।”
মায়া বলল—
— “আজ থেকে…
রাত আর দিনে
আমি তোর পাহারা হবো।
ও যে-ই হোক…
আমি তাকে ধ্বংস করব।”
ইরা তার বুকে মুখ লুকিয়ে বলল—
— “আর আমি তোমাকে ভাঙতে দেব না।”
একটা নতুন প্রতিজ্ঞা
দুজনে নীরবে করে ফেলল।
ভালোবাসার প্রতিজ্ঞা।
অন্ধকারের প্রতিজ্ঞা।
অধিকারের প্রতিজ্ঞা।
আর সেই ছায়া-মানুষটা?
সে ফিরে আসবে।
কারণ গল্প এখনো শেষ হয়নি।